মোঃ শাহারুখ আহমেদ-
২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশে শান্তিপূর্ণ ভাবে ৫২’র মহান শহীদদের অতুলনীয় আত্মত্যাগের বিনিময়ে উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারি’। এই উপলক্ষে দেশের বিভাগীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোকে নানান রং এ সাজানো হয়েছে। রাজধানী ঢাকা দৃশ্যমান রুপে সজ্জিত হয়েছে, কেন্দ্রীয় শহীদমিনার সহ সারাদেশের অন্যান্য শহীদমিনারকে কেন্দ্র করে ভাষা শহীদদের জন্য আয়োজিত হচ্ছে বিশেষ দোয়া মুনাজাত ও পুষ্প স্তবক অর্পণ।

নিখুদ ষড়যন্ত্রে যখন উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছিল তখন ১৯৫২ সালের এই দিনে ‘মাতৃ ভাষা বাংলা চাই, মায়ের ভাষায় বলতে চাই’ এই স্লোগান নিয়ে একদল সৈনিক রাজপথ উত্তাল করেছিল বাংলাভাষার সম্মান রক্ষার্থে। কিন্তু হঠাৎ দুপুর বেলায় বন্য পশুর নেয় বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়া হল তাদের লক্ষ করে। আকাশ, বাতাস যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ, রাজপথ ঢেকে গেল লাল রক্তের চাদরে। রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, সফিউলদের এর মত ঝরে গেল বহু তরতাজা প্রাণ, পুর্ণাঙ্গ লাশে পরিনত হয়ে রাস্তায় পরে রইল তাদের নিথর দেহ। আহত হয়েছে অনেকে।
১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষনা করে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তৎক্ষণাৎ উপস্থিত ছাত্রনেতা ও জনতা এই কথার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা হয় ১৯৫২ সালের ২৭শে জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন এর ভাষণের মাধ্যমে, সেদিন পল্টন ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণ এর পুনরাবৃত্তি করা হয়। তাই ৩০শে জানুয়ারি ধর্মঘট ও ৩১শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বার লাইব্রেরি হলে’ ছাত্রনেতারা সভার মাধ্যমে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে হরতাল, সমাবেশ, মিছিল কার্যকরী করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ফলে সরকার খুব চাপে পড়ে যায় তাই তড়িঘড়ি করে ২০শে ফেব্রুয়ারি সরকার পরদিন থেকে এক মাসের জন্য হরতাল সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ করে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ছাত্রনেতারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক সভা-সমাবেশ, হরতাল চালু করে।

ছোট মিছিলের মাধ্যমে শুরু হয় তাদের কার্যক্রম। পুলিশের সাথে চলতে থাকে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। সকাল ৯টা থেকে শুরু হযে় ঠিক যখন দুপুর তখন গণপরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হতে থাকা একটি মিছিলের উপর চালানো হয় বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি। বহু শিক্ষার্থী হয়ে গেল লাশ। পরবর্তীতে ২২শে ফেব্রুয়ারি উপায়ন্তর না পেয়ে রুহুল আমিন সরকার আইন পরিষদে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার একটি প্রস্তাব আনে ও সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবটি পাস হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে ২৬শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান পার্লামেন্টে বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করে সংবিধান গৃহীত হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ২০১০ সালে ২৩শে নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের চতুর্থ কমিটিতে বাংলাদেশ ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব আনে। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়ে যায়। সেই দিন থেকে সারাবিশ্বে একুশে (২১) ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। তাছাড়া ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রথম বাংলা ভাষায় বক্তব্য রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান। আর বাংলা ভাষা সম্পর্কে বিশ্ববাসী জানতে পারে ১৯১৩ সালে রচিত নোবেল জয়ী মহা কাব্য ‘গীতাঞ্জলি’ দিয়ে, যার রচয়িতা ছিলেন রাবিন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ভাষার নিরিখে বাংলা ভাষা পঞ্চম স্থানে রয়েছে- চীনা-স্প্যানিও, ইংলিশ, আরবি ও হিন্দির পরে বাংলা ভাষার অবস্থান। এই মুহূর্তে ৩০ টি দেশে ১০০ টি ইউনিভার্সিটি তে চালু রয়েছে বাংলা বিভাগ। বাংলাদেশ ভারতের পর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বাংলা ভাষার চর্চা হয় ব্রিটেন ও আমেরিকায়। বর্তমানে ৬ টি দেশের রাষ্ট্রীয় বেতারে বাংলা ভাষার আলাদা চ্যানেল রয়েছে। এছাড়াও আরও ১০ টি দেশের রেডিওতে বাংলাভাষার আলাদা অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়। ব্রিটেনে ৬ টি ও আমেরিকায় ১০ টি বাংলাদেশি মালিকানাধীন বাংলা ভাষার টিভি চ্যানেল রয়েছে। ইউরোপের ইতালিতে বর্তমানে পাঁচটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা এবং রোম ও ভেনিস শহর থেকে ৩ টি রেডিও স্টেশন পরিচালিত হচ্ছে। তাছাড়া ফ্রান্সে বাংলা দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত করার লক্ষ্য ব্যবস্থা গ্রহন করা হচ্ছে, থাকবে রেডিও স্টেশন। এভাবেই সারা বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষা রয়েছে সমুন্নত। যার শুরুটা হয়েছিল ৫২’র যুবকদের রক্তে মাখা লাল রাজপথের মর্মান্তিক অতীত দিয়ে। তাইতো বলতে বাধ্য হই, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি। একুশ মানে অহংকার, একুশ বাংলার অলংকার।
Discussion about this post