রায়হান সিদ্দিকী, বেনাপোল প্রতিনিধি:
সম্প্রীতির বন্ধন, ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব সব কিছুতেই ফাগুনের ছোঁয়া, তারপরও বুকের ভিতর মুষড়ে ওঠে এক অজানা কষ্ট, আমার ভাইয়ের রক্তে ভেজা রাজপথ ধরে যখন ছোট্র শিশুটি এক তোড়া ফুল হাতে শহিদ মিনারের দিকে এগিয়ে যায় তখন মাথার উপর উড়তে থাকা পাখিটাও আনমনে গেয়ে উঠে- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১ শে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার সকালে বেনাপোলে ভারত-বাংলাদেশ নোমান্সল্যান্ড এলাকায় দু‘বাংলার মানুষ মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করলো। বেনাপোল সীমান্ত মুখরিত হলো দুই বাংলার মিলন মেলায়। উভয় বাংলার ভাষাপ্রেমী মানুষ শহিদদের প্রতি জানিয়েছে গভীর শ্রদ্ধা। দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানে দুই বাংলার মানুষকে অনুপ্রাণিত করছে।
অনুষ্ঠানে দু‘বাংলার আমন্ত্রিত অতিথি মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, প্রশাসনের কর্মকর্তারা, কবি, সাহিত্যক, লেখক, সঙ্গীত শিল্পী এবং দু‘বাংলার ভাষা প্রেমী মানুষেরা অংশগ্রহণ করেছেন। দু‘বাংলার মানুষের এ মিলন উভয় দেশের সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে অনুষ্ঠানকে সার্থক করতে দু‘দেশের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকদফা বৈঠকও হয়েছে দুই সীমান্তে। এবার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ‘জয় বাংলা, জয় ভারত’ যৌথ শ্লোগানে বেনাপোল-পেট্রাপোল চেকপোষ্টে এবার উদযাপিত হবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
বেনাপোল-ভারত সীমান্তে মাতৃভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষে দুদেশেই চলছে নানা আয়োজন। ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নোম্যান্সল্যান্ড এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে অস্থায়ী শহিদ বেদি। যেখানে উভয় দেশের নেতৃবৃন্দ সকাল ৯টায় শহিদ বেদীতে ফুল দিয়ে অনুষ্ঠানটি শুরু করেন। এরপর উভয় দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। উভয় দেশের চেকপোস্ট ইমিগ্রেশনের সামনে তৈরি করা হয়েছে সুসজ্জিত ২১শে মঞ্চ।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে প্রধান অতিথি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্রাচার্য্য এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন যশোর-১ (শার্শা) আসনের সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন, বেনাপোল কাস্টম হাউজের কমিশনার মো: আব্দুল হাকিম, যশোর জেলা প্রশাসক মো: তমিজুল ইসলাম খান, পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ার্দ্দার, যশোর ৪৯ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্ণেল আহমেদ হাসান জামিল, বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (ট্রাফিক) আব্দুল জলিল, শার্শা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নারায়ন চন্দ্র পাল, পুলক কুমার মন্ডল, নাভারন সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার নিশাত আল নাহিয়ান, শার্শা উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খলিল। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন পরিষদের আহবায়ক শার্শা উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম মঞ্জু।
অপরদিকে ভারতের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন প্রধান অতিথি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। বিশেষ অতিথি ছিলেন উত্তর ২৪ পরগণা জেলা পরিষদের সভাপতি, বিধায়ক শ্রীমতী বীনা মন্ডল, বিধায়ক বিশ^জিৎ দাস, বনগাঁ পৌর সভার পৌর প্রধান গোপাল শেঠ, বনগাঁ লোকসভার প্রাক্তন সংসদ শ্রীমত্যা মমতা ঠাকুর, উত্তর ২৪ পরগণা জেলা পরিষদের অধ্যক্ষ শ্যামল রায়, বনগা পৌর সভার উপ পৌরমাতা শ্রীমতি জ্যোৎস আঢ্য, গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি গোবিন্দ দাস, বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির দলনেতা ও কর্মাধ্যক্ষ সৌমেন দত্ত, ছয়ঘরিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত সমিতির প্রধান প্রসেনজিৎ ঘোষ। এছাড়াও একুশের কবিতা আবৃতি, ছড়া, গীতিনাট্য, আলোচনা আর সংগীতানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
দু‘বাংলার মানুষের এ মিলন উভয় দেশের সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতি বছরই দুই বাংলার সীমান্তবর্তী এ অংশের বাসিন্দারা এক সাথে মিলিত হয়ে দিবসটি পালন করেন। তখন দুই দেশের সীমান্তের মধ্যবর্তী ওই স্থানে আবেগাপ্লুত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। একে অপরকে আলিঙ্গন করে সকল ভেদাভেদ যেন ভুলে যায় কিছু সময়ের জন্য। ফুলের মালা দিয়ে উভয় দেশের আবেগপ্রবণ অনেক মানুষ বাঙালীর নাড়ির টানে একজন অপরজনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। দুই বাংলার মানুষের মাঝে বসে এক মিলন মেলা।
ভারত-বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন অংশ নেয় এ অনুষ্ঠানে। এ সময় পেট্রাপোল ও বেনাপোল চেকপোস্টে ঢল নামে হাজার হাজার মানুষের। ক্ষনিকের জন্য হলেও স্তব্দ হয়ে যায় আন্তর্জাতিক সীমারেখা।
২০০২ সাল থেকে দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল চেকপোস্টের জিরো পয়েন্টে মাতৃভাষা দিবস পালন করে আসছে দু‘বাংলার মানুষ। সমগ্র অনুষ্ঠানে নেয়া হয়েছে নজিরবিহীন নিরাপত্তা। কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে দুই সীমান্তে। বেনাপোল-পেট্রাপোল চেকপোস্টে যাতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বিজিবি ও বিএসএফ অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করেছে দুই সীমান্তে।
Discussion about this post