বেকারত্ব একটি সামাজিক ব্যাধি বা সংকট। কর্মক্ষম মানুষ যখন তার কোনো পেশা খুঁজে না পায় তখন তাকে বেকার বলা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিচালিত শ্রম শক্তি জরিপে (২০০২–০৩ ও ২০০৫–০৬) ১৫ বছর বা তদুর্দ্ধ বয়সের মানুষকে বেকার বলে অভিহিত করা হয়। অনেকে মনে করেন,বর্তমানে দেশে কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে প্রায় ২৩ লাখ কর্মহীন। আবার পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিচালিত শ্রম শক্তি জরিপ (২০১৬–১৭) অনুযায়ী শিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিত মোট বেকার ২৬ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ। পুরুষ ১৩ লাখ ৪৭ হাজার নারী ১৩ লাখ ৩০ হাজার। এরমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা ৪ লাখ ৫ হাজার। যারমধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৩৪ হাজার ও নারী ১ লাখ ৭১ হাজার।
আইএলও – এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব সবচেয়ে বেশী। যা ১০.৭ শতাংশ হারে বাড়ছে। এই হার এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ২৮ টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ । পরিসংখ্যানবিদদের মতে প্রতি বৎসর দ্বিগুন হারে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে।
করোনায় বেকারদের অস্হিরতা আরও বেড়ে গেছে। অনেক বেকার মার্চ-এপ্রিলে নিয়োগ পরিক্ষা দেওয়ার আশায় ছিল। কিন্ত করোনা পরিস্থিতিতে কখন সে পরীক্ষা হবে তা আর বলা যাচ্ছেনা । এদিকে অনেকের চাকরির বয়স শেষ হতে চলছে। একদিকে করোনা আতংক অপরদিকে বেকারত্বের অভিশাপ এই নিয়ে বেকাররা মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন বলে অনেকে বলেছেন । সবমিলিয়ে পড়াশোনাতেও মন বসাতে পারছেনা তারা। লজ্জায় ত্রাণের জন্যও হাত বাড়াতে পারছেনা বা কেউ তাদের খবরও রাখছেনা। অনেক বেকার টিউশনি করে চলে বর্তমান পরিস্থিতিতে তাও নেই।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর কর্মবাজারে প্রবেশ করছে( সব স্তরের) প্রায় ২৭ লাখ, আর চাকরি পাচ্ছে ১ লাখ ৮৯ হাজার।আইএলও এর মতে বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ বেকার।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বেকারত্বেের হার বাংলাদেশেই বেশী। ২০১০ সালের পর থেকে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা ও ভূটান এ হার কমিয়ে এনেছে।ভারতে স্থিতিশীল রয়েছে। তবে বেড়েছে বাংলাদেশ,পাকিস্তান ও নেপাল।
বাংলাদেশের মোট কর্মসংস্থানের ৯০ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। মূলত কৃষিখাতে কর্মসংস্থান বেশী হওয়াতে অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার বেশী ।বেকারত্ব সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি স্বরুপ ।
উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে শিক্ষার্থীরা শ্রমবাজারে প্রবেশ করার মিছিলে যোগ দিলেও সে হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছেনা।
একজন অভিভাবক তার সন্তানকে মাসে মাসে টাকা দিয়ে পড়াশোনা করায় । শিক্ষাজীবন শেষ করলের আশায় বুক বাঁধে তার সন্তান চাকরি করে সংসারের হাল ধরবে।বুড়ো পিতামাতার মুখে হাসি ফুটাবে।দেশ ও জাতির কল্যাণে অবদান রাখবে। আবার অনেকে টিউশনি করে বা পার্ট টাইম জব করে পড়াশোনা করে আশা রাখে একটি চাকরির। কিন্তু দিনে দিনে যখন চাকরি নামক সোনার হরিণ হাতে আর আসছেনা তখন মনের মধ্যে অনুভূত হয় এক নিরব যন্ত্রণা। যে যন্ত্রণার খবর হয়তো কেউ রাখেনা। অনেককে নিরবে কান্না করতে দেখেছি।হতাশা আর নিরাশা তাদের জীবনে ভর করে। তাদের চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে।তখন হতাশায় অনেকে অপকর্মের আশ্রয় নেয়।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, উচ্চ শিক্ষা এখন আর কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিতে পারছেনা।অপরদিকে মানসম্মত শিক্ষাও অনেকক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা পায় না। এক্ষেত্রে মানসম্মত শিক্ষকেরও বড় অভাব।শিক্ষকতা পেশা লোভনীয় না হওয়াতে অনেকে এ পেশায় আসতে চান না।সামাজিক মূল্যায়ন ও আর্থিক বৈষম্যের কারনে এ পেশায় বর্তমানে মেধাবীরা আসতে চাচ্ছেন না। সরকারি কলেজেও পদোন্নতি ও গ্রেড বৈষম্যের দিক লক্ষ্য করে অনেকে এ পেশায় আসতে অনীহা প্রকাশ করছেন।আবার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও শুনা যায় রাজনৈতিক নিয়োগের কারনে শিক্ষক নিয়োগ যথার্থ হয়না।তাই সবক্ষেত্রে মেধাবী শিক্ষক আসলে এবং তাদের কাছে এ পেশাকে সামাজিক ও আর্থিকভাবে লোভনীয় করতে পারলে শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা লাভ করতে পারবে।শুধু সার্টিফিকেট সর্বশ্ব শিক্ষার দিকে না ঝুঁকে মানসম্পন্ন শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে।
মনে রাখতে হবে, কোন জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা অথবা ক্ষেপণাস্ত্র দরকার নেই।শিক্ষাকে পঙ্গু করতে পারলেই হয়।শিক্ষা ব্যবস্হা ভেঙ্গে পড়ার মানে হল একটি জাতির অবলুপ্তি।
বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী চাকরি নিতে পারে । বাকি প্রায় ৮০ ভাগ কর্ম খুঁজে পেতে হিমশিম খেতে হয়।এমতাবস্থায় আমার মতে উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর সরকার প্রয়োজন মাপিক সাধারণ শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থী রেখে বাকিদেরকে প্রফেশনাল ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করালে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষার্থী দেশে সৃষ্টি হবে।
দেখা যায় উচ্চ শিক্ষার সার্টিফিকেট নিয়ে দ্বারে দ্বারে গুরার পরও যখন সোনার হরিণ চাকরিটা না পায় তখন তার সনদ ও জীবন দু’টোর ওপরই চরম বিতৃষ্ণা এসে যায়। এজন্য উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পরই নিজের জীবনের গতি ঠিক করে নেয়া উচিত। কারণ কারিগরি উচ্চশিক্ষা অর্জন করলে সরকারি ও বেসরকারি চাকরির চাহিদা থাকে অথবা নিজে উদ্যোক্তা হয়ে অনেকেরই কর্মসংস্থান করতে পারে।এভাবে শিক্ষা ব্যবস্হাকে ঢেলে সাজালে শিক্ষিত তরুণরা দেশের বোঝা না হয়ে দেশের সম্পদে পরিণত হবে।
সরকার শিক্ষানীতিও এভাবে প্রণয়ন করেছেন।এখন প্রয়োজন আমাদের সঠিক পথটি খুঁজে নিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে এগিয়ে আসা। শুধু সরকারকে দোষ না দিয়ে নিজেদের গতি ঠিক করে নেয়া।তাহলেই দেশে বেকার হ্রাস পাবে। নিজেরা সমৃদ্ধি লাভ করব,দেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে।
লেখকঃ মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, বিভাগীয় প্রধান,ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, আনন্দ মোহন কলেজ,ময়মনসিংহ ।
Discussion about this post