যশোর জেলা প্রতিনিধি, মনিরুজ্জামান মনির :
খেজুরের রস গুড়ে দেশ জুড়ে খ্যাতি অর্জন করে আছে যশোর জেলা। শীত মৌসুম আসলেই যশোরের গুড়ের দিকে চেয়ে থাকে অধিকাংশ জেলার মানুষ। বিদেশে কর্মরত বাঙ্গালিদের কাছে সমান কদর রয়েছে এ গুড়ের। যশোরের গুড়ের এ সুনাম ও চাহিদাকে পুঁজি করে এক শ্রেণির অসাধু মানুষ চালাচ্ছে ভেজাল কারবার। ভেজালের প্রভাব এতটা বেশি যে, আসল গুড়-পাটালি চিনতে এক প্রকার ধাঁধায় পড়তে হচ্ছে ক্রেতাদের। তবে বেশিরভাগ গুড় পাটালি ঐতিহ্য মেনেই তৈরি হচ্ছে। ক্রেতারা একটু সচেতন হলেই চিনতে পারবে খাঁটি গুড়। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব চিত্র।
সুখ্যাত পাটালি তৈরি হয় খাজুরার বাউনডাঙ্গা অঞ্চেলে। সুস্বাদু ও রসালো পাটালি তৈরিতে গাছিরা ফিটকিরির পাশাপাশি চিনির ব্যবহার করে থাকেন। ভেজাল হিসেবে নয় উপকরণ হিসেবে এ চিনি না মেশালে এ বিশেষ পাটালি তৈরি করা যায় না বলে জানিয়েছেন গাছিরা। আবার বীজ মারতে (জমাট গুড় বা পাটালি তৈরির কৌশল) কখনো আবার চিনি ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়।
বেশি মুনাফা প্রত্যাশী গাছিরা অধিক পরিমাণে চিনি মিশিয়ে গুড়ের পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। এতে নষ্ট হয় গুড়ের গুণাগুণ ও স্বাদ। তবে খাঁটি গুড়ে ভেজাল হিসেবে চিনির থেকে বেশি মেশানো হচ্ছে দোকাট গুগ বা টকগুড়। কখনো কখনো গুড় সাদা করতে ফিটকিরি, রসের পরিমাণ বাড়াতে বিচালি ভেজানো পানি, চুনের পানি ও গুড়ের সেন্ট মেশানোর তথ্য মিলেছে গাছিদের কাছ থেকে। গাছিরা বলছেন, তারা খাঁটি গুড়ই তৈরি করতে চান। তবে ক্রেতাদের ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা ও দাম কম দেয়ার মানসিকতার জন্য গুড়ের সাথে চিনি কিংবা অন্য কিছু মেশানো হয়।
যশোরের এক ভাড়(৪ কেজি) জিরেন রস (টাককা রস) বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। এক কেজি গুড় তৈরি করতে প্রায় ৮ কেজি(দুই ভাড়) রসের প্রয়োজন হয়। দুই ভাড় রসের দাম ৫০০ টাকা। কিন্তু মানসম্মত এক কেজি গুড় বিক্রি হচ্ছে মাত্র সাড়ে তিনশ টাকায়। রসেই শুধু গুড় হয় এমন নয় এর সাথে যোগ হয় জ্বালানি ও গাছির পরিশ্রম। এ হিসেবে গুড় তৈরি করে বিক্রির চেয়ে রস বিক্রি অনেক লাভজনক। তারপরেও গাছি গুড় তেরি করছেন ও তুলনামূলক কম দামে বিক্রি করছেন। রসের চেয়ে গুড়ের দাম তুলনামূলক কম হওয়াটা স্বাভাবিক মনে করা সম্ভাব নয়।
বাউনডাঙ্গার গাছিরা জানিয়েছে ‘খাজুরার মোটা পাটালি তৈরিতে কিছু পরিমাণ চিনি ব্যবহার করতে হয়। না করলে জমাতে একটু সমস্যা হয়। এই পাটালিতে চিনি ব্যবহার না করলে সুস্বাদু ও রসালোও হয় না। খাটি গুড় ও পাটালি একটু কালচে বর্ণের হয়ে থাকে। ক্রেতাদের নজর কাড়তে পাটালি সাদা করতে সাধারণত হাতের পরিমাপে রস জ্বালানোর সময় ফিটকিরি মেশানো হয়ে থাকে।’
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, কতিপয় গাছি অধিক মুনাফার জন্য বেশি পরিমাণে চিনি ব্যবহার করছেন। কখনো কখনো চিনির পরিমাণ গুড়ের থেকে অধিক দেওয়া হচ্ছে। কয়েক জন গাছির ঘরে বস্থা ভরা চিনিও দেখা মিলেছে। কেউ কেউ আবার রাতের আধারে চিনি পানিতে ভিজিয়ে রাখে এবং চিনি খুব সকালে মানুষের চোখের আড়ালে রসের সাথে মিশিয়ে দেয়।
কাশিমপুর গ্রামের গাছি আমিন বিশ্বাস জানান, খাটি গুড়-পাটালি একটু কালচে বর্ণের হয়ে থাকে। এ পাটালি বেশি দিন থাকে না। আগের মতো এখন আর বাগান নেই যার কারণে রস জ্বালানোর কাঠও নেই। বাজারের চিনি দেওয়া সাদা পাটালি অনেক দিন থাকে। চিনি দেওয়া পাটালি ২’শ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলেও তাদের লাভ হয়। কারণ দুই ঠিলে রস জ্বালানোর পরে ১ কেজি মতো পাটালি হয়। আর যারা চিনি ব্যবহার করে তারা দুই ঠিলে রসে ২-৩ কেজি পাটালি তৈরি করে। ভেজাল পাটালি-গুড়ের কারণে ক্রেতাদের মনে কোন আস্থা নেই। অনেকের খাঁটি গুড় দেখানোর পরে চিনতে পারে না। যার কারণে আসল পাটালি-গুড় বিক্রি করতে আমাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
হাঁপানিয়া গ্রামের আলম হোসেন জানান, আমরা খাঁটি গুড় তৈরি করি। ভেজাল কিভাবে তৈরি করতে হয় সেটায় বুঝি না। আমাদের গুড় অর্ডার নিয়ে শেষ করতে পারি না। গুড় সাধারণত ২৫০-৩’শ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি। ভেজাল গুড়ে বাজার ছেয়ে গেছে, দাম বেশি হলে বিক্রি হচ্ছে না তাই কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। বর্তমানে জিনিস-পত্রের দাম হিসেব করলে গুড়ের দাম অনেক কম। কারণ সকাল থেকে দুপুর ১টা পর্যšত্ম মাঠে কাজ করলে কৃষাণকে দিতে হয় ৪-৫’শ টাকা। গুড় তৈরিতে পরিশ্রমের হিসেব করলে অনেক লোকসান। তাছাড়া উচ্ছে করলেই প্রতিদিন রস পাওয়া যায় না। খাঁটি জিরেন রস পেতে খেজুর গাছকে বিশ্রাম দিতে হয়।
গাছিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে খাঁটি পাটালি আগুল দিয়ে চাপ দিলে নরম হবে। শক্ত হলে বুঝতে হবে কিছু মেশানো আছে। গুড় যদি একটু বেশি চকচকে হয়, রস ভালো ছিল না নতুবা কিছু মেশানো। ভালো গুড়ের রং সব সময় গাঢ় খয়েরি বা একটু কালচে অথবা গাঢ় বাদামি রঙের। গুড়ের রং যত হালকা হবে বুঝতে হবে ভেজাল আছে। নতুন গুড়ে নুনতা স্বাদ থাকে না। তাছাড়া গুড় গালে দিলে যদি কচকচ করে তবে চিনি মেশানো আছে বুঝতে হবে। আসল গুড় মুখে দিলেই গলে যায়।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বর্ননা মতে ফিটকিরি সবচেয়ে উপযুক্ত জীবাণুনাশক ওষুধ। বেশি পরিমাণে ফিটকিরি খেলে পেটের ব্যাথা বা বিষক্রিয়াও হতে পারে।
বৃহত্তর কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চল কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের অতিরিক্ত উপপরিচালক সেলিম হোসেন বলেন, আমাদের দেশে পাটালি-গুড়ে ভেজালের বিভিন্ন ধরণ রয়েছে। এগুলোতে আমাদের শরীরের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু যশোর জেলার কৃষক বা গাছিদের মধ্যে দেখা যায় তারা পাটালি-গুড়ে ব্যবহার করে চিনি। যা মানব দেহের জন্য ড়্গতিকর নয়। তবে পাটালি-গুড়ের আসল স্বাদ ভিন্নতা তৈরি করে। মানুষ টাকা দিয়ে যে জিনিস পেতে চায় সেটা পাচ্ছে না। ক্রেতারা নিয়মিত প্রতারনা শিকার হচ্ছে।
তিনি ব্এলেন, টা বড় ধরনের প্রতারনা। তাই আমরা গাছিদের নৈতিকতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন জায়গায় গাছিদের বাড়িতে প্রদর্শনী হিসেবে চুলা তৈরি করা হয়েছে। পাটালি-গুড়ের ভেজাল মুক্ত করার জন্য অনেক কৃষকদের শপথ করানো হয়। অনেক কৃষক আমাকে বলে স্যার ১ কেজি গুড় তৈরি করতে ৭-৮ কেজি রস লাগে। কিন্তু এ গুড় বাজারে নিয়ে ২’শ থেকে আড়াই’শ টাকা বিক্রি করি এবং যারা চিনি মেশায় তারাও একই দামে বিক্রয় করে। আমরা সেই গাছিদের বলে থাকি মানুষের মনের আস্থা তৈরি করতে একটু সময় লাগে। আবার অনেক কৃষক আছে যারা খাঁটি গুড়-পাটালি তৈরি করছে। অনেক সময় ভেজালের কারণে খাটি গুড়-পাটালি বিক্রয় করতে সমস্যায় পড়ে। কিন্তু খাঁটি গুড়-পাটালি তৈরিতে মানুষের মনে আস্থা হলে তখন আর কৃষক সরবরাহ দিয়ে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন মানুষের মনের আস্থা তৈরি করা।
Discussion about this post