রানা মুহম্মদ সোহেল,বগুড়া প্রতিনিধিঃ
বগুড়া শাজাহানপুর উপজেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ডেইলি এশিয়া পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার তোফাজ্জল হোসেন। বাড়ি বগুড়ার শেরপুরে। তাঁর নিমন্ত্রণেই শেরপুর ঘুরতে যাওয়া। কী আছে সেখানে, জানতে চাইলেও মুখ খোলেনি সে। তাঁর এক কথা। আসো আগে, তারপর দেখতে পাবে।
শনিবার, ছুটির দিন সকাল থেকেই কুয়াচ্ছন্ন, অদেখাকে দেখার কৌতূহল নিয়ে শেরপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। শেরপুরে পৌঁছাতেই তোফাজ্জল হোসেনের উষ্ণ অভ্যর্থনা। দুজন মিলে শেরপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে অটোরিকশায় করে চললাম শাহবন্দেগী ইউনিয়নের খন্দকার টোলা গ্রামে। তোফাজ্জল জানালো এই গ্রামেই রয়েছে মুসলিম স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন—খেরুয়া মসজিদ। বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদের নির্মাণশৈলীর সঙ্গে বেশ মিল। মসজিদটি নাকি প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো। ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল একটি পুরনো কবর। তাতে শায়িত আছেন আবদুস সামাদ নামের এক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক মানুষ। মসজিদটির স্বপ্নদ্রষ্টা তিনিই।
মসজিদের পুরো চত্বর যেন কার্পেটের মতো। ইট, সুরকি, চুন, পাথর ও পোড়ামাটির ফলক দিয়ে নির্মিত হয়েছে মসজিদটি। সামনের অংশের ইটে ফুল লতা-পাতা খোদাই করা নকশা। মিনার, গম্বুজ, নকশা ও ইটের বৈচিত্র্যময় গাঁথুনি মিলে পুরো স্থাপনাটি বেশ নান্দনিক। চারপাশে তাল, নারকেল, আম ও কদমগাছের সারি। ইটের প্রাচীরের ওপর লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। মসজিদটির মোট জায়গার পরিমাণ ৫৯ শতাংশ। মসজিদটি নাকি সম্রাট আকবরের আমলে তৈরি। এতে ১২ কোনা ও আট কোনা কলাম ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এর নামকরণের ইতিহাস কেউই বলতে পারেননি।
মসজিদটিতে ভেতর তিনটি কাতারে প্রায় ১০০ জন নামাজ পড়া যায়। মসজিদের চারপাশ ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির উত্তর-দক্ষিণ দেয়ালে একটি করে দরজা। আর পূর্ব দিকে তিনটি দরজা। মাঝেরটি আকারে বেশ বড়। এই দরজার দুই পাশের দেয়ালে দুটি করে শিলালিপি বসানো। চারকোণে চারটি অষ্টভুজ মিনার। পশ্চিম দেয়ালের ভেতরে রয়েছে আয়তকার তিনটি মেহরাম। আকারের দিক দিয়ে মাঝেরটি তুলনামূলক বড়। অনন্য স্থাপত্যশিল্প ও দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদটি দীর্ঘদিন অবহেলায় পড়েছিল।
অবশেষে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে মসজিদটির সংস্কার করা হয়। বর্তমানে মসজিদটি দেখভালের জন্য একজন খাদেম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখানকার এক বাসিন্দা জানালেন, সংস্কারের আগে মসজিদটি প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষণের দায়িত্ব নেওয়ার পর চারদিকে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। পরিবেশ আকর্ষণীয় করে তুলতে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ।
আরেকজন জানান, মসজিদটির ইতিহাস নিয়ে একটি বইও আছে। নাম ‘শেরপুরের ইতিহাস [অতীত ও বর্তমান], লেখক অধ্যক্ষ মুহম্মদ রোস্তম আলী। ইতিহাস জানতে বইটি কিনলাম মসজিদের ইমামের কাছ থেকে। বইটিতে লেখা তথ্যমতে, তখন ১৬ শতকের শেষ দিক। সময়টা ছিল বারোভূঁইয়া ও মোগলবিরোধী বিপ্লবের সংকটকালীন মুহূর্ত। কাকশাল বিদ্রোহীদের শক্ত ঘাঁটি ছিল শেরপুর মোর্চা। বারোভূঁইয়া ছাড়াও আফগান বিদ্রোহীদের নেতা মাসুম খান কাবুলির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে কাকশাল বিদ্রোহীরা। সেই সময় এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
মসজিদের দেয়ালে লিপিবদ্ধ শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে জওহর আলী খান কাকশালের ছেলে নবাব মির্জা মুরাদ খান নির্মাণ করেছিলেন এটি। মসজিদের উত্তর-দক্ষিণের দৈর্ঘ্য ১৭ দশমিক ৩৪ মিটার। পূর্ব-পশ্চিমের প্রস্থ ৭ দশমিক ৫ মিটার। ভেতরের দৈর্ঘ্য ১৩ দশমিক ৭২ মিটার ও প্রস্থ ৩ দশমিক ৮ মিটার। মসজিদের ছাদের নিচে পায়রাদের বসবাসের জন্য পৃথক কিছু জায়গা নির্মাণ করা হয়েছিল। মসজিদের একটি শিলালিপির ভেতরে ছিল স্বর্ণখণ্ড, যা পরবর্তী সময়ে চুরি হয়ে যায়। এই মসজিদের একটি শিলালিপি বর্তমানে পাকিস্তানের করাচি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়।
ফেরার সময় কথা বলি মসজিদের তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে। তিনি জানান, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পর্যটকরা নিয়মিত মসজিদটি দেখতে আসেন। মসজিদটির নির্মাণশৈলী দেখে সবাই খুব মুগ্ধ হন।
Discussion about this post