মোঃ শাহারুখ আহমেদ।
কোকিলের কুহু কন্ঠে, অতিথি পাখির ডানায় ভর করে, নানা রং নানা ঢং এর ফুলের মিষ্টি হাসিতে, ফল ফলাদি, ফসল ফসলাদিতে হাট বাজার মাঠ কাঁপিয়ে, রকমারি ডিজাইনের ঝকমারি পোশাকের উষ্ণতার চাদরে বছর ঘুরে আবারও সিক্ত সমগ্র বাঙালি শীতের মায়াবি আবেশে। এই দিনে নানি, দাদী ও মায়েদের ব্যস্ততার শেষ নেই, চিতল পিঠা, কুলি পিঠা, ফুল পিঠা, দউলা পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, গুরেরে পিঠা, আন্দেশা পিঠা, নাড়ু পিঠা, ভাপা পিঠা, ডুবা পিঠা, কাঠ পিঠা, হলুয়া, রসের গুড় ও আরো নানা রকমের বাঙালির ঐতিহ্যবাহী শীতকালিন মুখরুচক খাবার তৈরি হয় প্রতিটি ঘরে। শুরু হয় কাথা সেলাইয়ের উৎসব, সুঁইয়ের প্রতিটি সেলাইয়ের ফাঁকে যেন লুকিয়ে থাকে মায়েদের আবেগ, ভালবাসা, মায়া, সুখ ও দুঃখ।
গোধূলী বেলা শেষ হওয়ার পর শুরু হয় নিদ্রাৎসব। কাথা মুড়িয়ে ঘুমানোর ভাললাগা যেন এক আনন্দ যা কিনা হার মানায় সকল আনন্দকে। রাতের আনন্দ এখানেই শেষ নয়, রয়েছে গায়ের সকলে মিলে চাদর মুড়ি দিয়ে এক উঠনে বসে গাল গপ্পো করা, দাদী-নানি দের মুখে ইতিহাসের কিচ্ছা শোনা, বয়াতী গান, পালা গান, দিসটান, বাউল গান, ফকিরি গান, যাত্রা পালা ও নানা রকমের শীতের উৎসবে মেতে থাকে সবাই। এভাবে মধুর রাত শেষ হওয়ার পর আশে সৃষ্টিকর্তার আরেক দৃষ্টিনন্দন সৃষ্টি কুয়াশার চাদরে ঢাকা ভোর বেলা। যার রুপ বর্ণনা করে শেষ করা যায় না, যেন এক শিল্পীর তুলিতে আকা ছবি। মোয়াজ্জেনের কন্ঠে ভেসে আসা আযানের মায়াবি সুর এর পর পাখিদের কিচিরমিচির মিষ্টি আলাপচারিতায় ঘুম ভাঙ্গে সূর্যি মামার। ভোরের আলোয় ফোটা নানা রং এর ফুলের ঘ্রানে মেতে ওঠে পাখপাখালি। যেন সবুজ কন্যা নানা রং এর গহনায় নববধুর সাজে। শিশির বিন্দু গায়ে মাখিয়ে সবুজের বুকে ফিরে আনে নতুন যৌবন। খেজুর ও তাল গাছের রস পান করা যেন অদম্য নেশা। পানকৌড়ি, বুন হাঁস, পাতি হাঁস, চীনা হাঁস, রাজ হাঁস, বক, অক্কা, ডাহুক ও অতিথি পাখির মিছিলের ভিড়ে সারা পৃথিবীর সৌন্দর্য যেন অসহায়। ইচ্ছে করে তাদের মিছিলে যোগ দিয়ে ডানা মেলে উড়তে। ভোর বেলায় সকল পশুপাখি যেভাবে বেড়িয়ে পরে খাবারের সন্ধানে, তেমনই ভাবে কৃষক যায় মাঠে, জেলে যায় ঘাটে, আরো কিছু আছে, তাল ও খেজুর গাছে, কেউ যায় বন্দরে, কেউ যায় হাটে। এভাবে নানা পেশার মানুষ গুলো হাসিমুখে ছড়িয়ে পরে যে যার কর্মস্থলে। পরিবারের সকলের মুখে হাসি ফুটানোর বাসনা নিয়ে সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম এর পর সাজ বেলায় নারীর টানে ফিরে আসে যে যার আপন গৃহে। তারপর শুরু হয় সাজবেলার আনন্দ। কচি কাচা, যোয়ান, বুড়ো সকলে মিলে খাঁর খুটো একত্রিত করে আগুন জ্বালিয়ে চেষ্টা চলে শীত নিবারনের। কি আর লিখব এই সৌন্দর্যের কথা, যতক্ষণ লিখছিলাম ঠোঁটের ভাঝে লুকিয়ে থাকা হাসি বন্ধ হচ্ছিল না আর পর্দার লেখাগুলো দৃশ্য হয়ে ভাসছিল ভাবনার দুনিয়ায়।
তবে শীতকাল সবই যে ভাল লাগার খোরাক জোগায় সেটাও নয়। সকল আনন্দ হাসির মাঝে কোথায় যেন অপ্রত্যাশিত কিছু দৃশ্য চোখের পর্দায় বেত্রাঘাত করতে থাকে, কিছু সময়ের জন্য হলেও সকল ভাল লাগার অনুভুতিগুলো ‘হার্ডব্রেক’ এর নেয় বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীন দেশে সমান অধিকার নিয়ে জন্ম লাভের পরেও পরাধীনতার শিকলে বাধা বিরাট অংশের জনমানুষ, দারিদ্রতা ও দুর্নীতির কাটাযুক্ত কালো চাদরে সমস্ত শরীর ঢেকে কনকনে ঠান্ডার মধ্যে পড়ে আছে রাস্তার কিনারায়। তখন হঠাৎ মনে হয় ৭১ এর স্বাধীনতার যুদ্ধ খাতা কলমে ৯ মাসে বন্ধ হলেও বাস্তবে স্থগিত হয়েছে মাত্র, কিন্তু শেষ হয়নি। পরিবর্তন হয়েছে শুধু বিপক্ষ শত্রুদল। আগে ছিল বৃটিশ তারপর ছিল পাকিস্তানি হায়না আর এখন স্বজাতির কিছু অসাধু, বিক্রীত, নষ্ট ও আগ্রাসী মনোভাবের এক দল দুর্নীতিবাজ অমানুষ। যাদের মূল টার্গেট ক্ষমতার শিখর দখল করে জনমানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে দেশ ও মানুষকে জিম্মি করে তাদের টেক পূর্ণ করা। যাদের জন্য হাজারো জনগন মুখে হসি নিয়ে বুক চাপা আর্তনাদে অভিসাপ দিয়ে যায় সারাবেলা, হাড় হিম করা তীব্র শীতে আশ্রয় হিসেবে ঘর না পেয়ে হাজারো মানুষ কারো দেয়া চাদর বা কম্বল মুড়ি দিয়ে রাস্তার ধারে শুয়ে শুয়ে সূর্য উঠার অপেক্ষায় রাত যাপন করে নির্ঘুম চোখে। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে কোনো রকম বেচে থাকাই যাদের এক মাত্র লক্ষ্য। তাদের কষ্ট নিবারনের দায়িত্ব কার? এদেশের স্বাধীনতা ভোগ করার যোগ্যতা কি তাদের নেই? এছাড়াও এমন অনেকে আছে যারা সামাজিকতা বজায় রেখে চলতে গিয়ে তিন বেলা তো দুরের কথা দুই বেলা খেতেও কষ্ট হয়। তাদের ঘরেও ছোট্ট বাচ্চা রয়েছে, যাদের চোখে আছে অনেক স্বপ্ন, অনেক আকাঙ্খা যা কিনা অপূর্ণ থেকে যায়। তাদের আমরা দেখেও না দেখার ভান করে থাকি। অথচ তাদের প্রাপ্য অধিকার ভোগ দখল করে বিলাসিতা করে যাচ্ছে ঐ পাপিষ্ঠ নষ্ট চরিত্রের এক দল অমানুষ গোষ্ঠী।
যুদ্ধ করা উচিত তাদের সাথে, যারা স্বাধীনতা দিয়ে গদি বানিয়ে সেই গদির উপর বসে এক হাতে বন্ধুক অন্য হাতে কলম নিয়ে মানুষকে ধোকা দিয়ে বোকা বানাচ্চে। যাদেরকে বলা যায় ‘গদিদস্যু’। এই শীত যত আনন্দময় হউক না কেন, বুকের ভিতর কোনো এক জায়গা যেন ফাকা থেকে যায়। তাছাড়া ইসলামে যাকাতের উপরও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, যদি সঠিকভাবে আমরা যাকাত আদায় করি তাহলে শীতের নরকীয়তা কেটে সকলের জন্য স্বর্গ হয়ে উঠবে। ইচ্ছে হয় তাদের জন্য কিছু করতে, আমি মনে করি এই ইচ্ছে শুধু আমার একার নয়, স্বাধীনতাকামী সৎ ও সুন্দর মনের সকল মানুষের একই ইচ্ছে। তাই আমার বিশ্বাস আমাদের ইচ্ছে ও কর্ম যদি একত্রিত করতে পারি তবেই এ বাংলা সুন্দর ও স্বাধীন হবে। মাওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা, বঙ্গবন্ধু, জিয়াউর রহমানের, মতো মহামানবদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গঠিত হবে। শীত, বসন্ত, হেমন্তের মত নানা ঋতুর নানা রূপের নানা বৈচিত্র্যের নানা ঐতিহ্যের আদর্শ হবে এই বাংলাদেশ। এশিয়া সহ সারা বিশ্ব হবে বাংলাময়। সারা বিশ্বে বাংলা হবে একটি গবেষণার বিষয়। তবেই সার্থক হবে বলা, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।
Discussion about this post