কাউসার আহমেদঃ
বাবা আমার স্বামী মারা গেছে নয় বছর হয়। আমার চার কন্যা এবং একটি ছেলেসহ মোট সাত সদস্যের একটি সুখি পরিবার ছিল। আমার স্বামী থাকতে আমার তিন কন্যাকে বিয়ে দেন। কলিজার টুকরা ছেলেটাকে ও বিয়ে করান। বুকে অনেক স্বপ্ন ছিলো , আমার সন্তান পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হবে।কিন্তু সংসারের অভাবে ছোট থেকেই তাকে কাজ করতে হয়৷ আর অবশিষ্ট ছিল আমার প্রতিবন্ধী মেয়েটা। তাকেও বিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু সে প্রতিবন্ধী বলে তার স্বামী টাকা পয়সা নিয়ে তাকে ফেলে চলে যায়। এখন আমরা মা-মেয়ে এক সাথেই থাকি ।
স্বামী মারা যাওয়ার প্রথম এক সবছর আমার ভরণ-পোষণ বহন করে আমার ছেলে। কিন্তু হঠাৎ একদিন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে আমাকে আমার ছেলে মারধর করে। আমার খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়। তারপর থেকে বাসা বাড়ীতে কাজ করে মা মেয়ে সংসার চালাই।
আমার প্রতিবন্ধী মেয়েটাকে ও কোন কাজে দেইনা। যদি সে কাজ করতে গিয়ে বাসার কোনকিছু ভেঙে ফেলে। যদি নিজের কিছু হয়ে যায়। তাহলে আমি তার পিছনে কোথা থেকে টাকা খরচ করবো। আমার তো তিনবেলা খাবার ব্যবস্হা করতেই নিজেকে হিমসিম খেতে হয়। আজ যদি আমার স্বামী বেঁচে থাকতো হয়তো এতটা কষ্ট করতে হতো না এটা আমার কথা নয়। এটা নারায়নগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার বিশনন্দী বিশনন্দী ইউনিয়নের কড়ইতলা গ্রামের রাবেয়া বেগম নামের একজন অভাগা দুঃখিনি মায়ের বুক ফাটা আর্তনাদ। যার সন্তান পৃথিবীতে থাকতেও মৃত। যাকে পঞ্চাশ বছরেও মাথার গাম পায়ে ফেলে নিজের ও পরিবারের খাবার সরবরাহ করতে হয়।
বর্তমানে বাসা বাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়ে তুলার মেইলে দৈনিক আট ঘন্টা কাজ করার বিনিময়ে সাড়ে চার হাজার টাকা বেতন পান। এ দিয়ে আমার মেয়েরা বেড়াতে আসলে তাদেরকে মেহমানদারি করেন এবং নিজেরা ও চলেন।কিন্তু বাবা এই টাকা দিয়ে সংসারে খরচ চালিয়ে কোন দিন আমার মেয়েকে একটা নতুন কাপড় ও কিনে দিতে পারি নি। রোজার ইদে যাকাতের যারা কাপড় দেয় তাদের কাছে গেলে যারা চিনে তারা একটা কাপড় দেয়। আর যারা না চিনি তারা তাও দেন না। মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে চিন্তায় পড়ি। আজ যদি আমি মরে যাই তাহলে আমার এই প্রতিবন্ধী মেয়েটাকে কে দেখবে। কে তাকে ডাকবে?
আমার এখন পঞ্চাশের উপরে বয়স কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেছি। আল্লাহ যেন আমাকে এমন করে আমার জীবনটা অতিবাহিত করে দেয়। আর সদা আল্লাহর দরবারে দোয়া করি আমার সন্তান যেন তার ছেলে সন্তান নিয়ে সুখে শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করে। তার ছেলে সন্তান যেন আমাদের ছেলের মতো এতো নিষ্ঠুর প্রকৃতি না হয়।
একজন মার কতোটা ভালোবাসা থাকলে এত কষ্ট ও দুঃখের মধ্যে ও নিজের সন্তানের জন্য মঙ্গল কামনা করতে পারে। আজ আমরা সেই মা কেই অবহেলা করি। যে মা দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে দুনিয়ার আলোর মুখ দেখিয়েছেন। আজ সেই মার পেটেই লাথি মারি। সেই মা’কেই অনাহারে রেখে কষ্ট দেই।
মা নিজে অনাহারে থেকে সন্তানকে আহার করিয়ে বড় করলো। আজ সেই সন্তান পেট পুরো খেয়ে নাক ডেকে ঘুমাই। মা খেলো নাকি খেলো না তার কোন খুঁজ নেয় না। হে আল্লাহ তুমি কাউকে এমন সন্তান দিও না, যে মা-বাবার খুঁজ না নিয়ে একা নিজের সন্তানদের নিয়ে আমোদ ফুর্তিয়ে মজে থাকবে। বোকা, তুমিও একদিন এমন হতে পারো তখন তোমাকে দেখার জন্য হয়তো তোমার সন্তানও তোমার পাশে থাকবে না।
Discussion about this post