বিশ্বজুড়ে অভাবনীয় সংক্রমণে জিম্মি আজ গোটা পৃথিবী। মানুষ আজ একা। শহর থেকে গ্রাম, দেশ থেকে মহাদেশ শুধু একাকীত্বের হাহাকার। কোথাও নেই কোলাহল। করোনা নামক এক প্রকৃতিক দুর্যোগে থামিয়ে দিয়েছে পৃথিবী। উন্নত, অনুন্নত সব দেশ-মহাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা আজ ভেঙ্গে পড়েছে। ইতিহাসে দুর্ভিক্ষ, মহামারি, হিংস্রতা-যুদ্ধ আর্থসামাজিক ও মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা সুস্পষ্ট।
পৃথিবীতে দুর্যোগ কিংবা মহামারির আঘাত আসে তখন তার প্রভাব স্বাস্থ্যের পাশাপাশি অর্থনীতি ও সামাজিক পর্যায়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বৈশ্বিক মহামারী করোনায় শুধু মানুষই মারা যাচ্ছে না, বরং বিশ্ব অর্থনীতিকেও ধমিয়ে দিচ্ছে। বেকারত্বের হার ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বেকারত্ব মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। করোনায় অর্থনীতি মহামন্দার সম্মুখীন, যা অতীতের সব মহামন্দাকেই ছাড়িয়ে যাচ্ছে। করোনার প্রভাবে বেকারত্ব বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত। ইতোমধ্যে কর্মী ছাঁটাই চলছে।আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে তাতে ৩৩০ কোটি কর্মক্ষম মানুষের আংশিক বা পুরোপুরি বেকার হবার সম্ভাবনা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আরও বলেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন সংকট আর আসেনি। গত ডিসেম্বরে আইএলও ২৫০ কোটি মানুষের নতুন করে বেকার হয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিল। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাব দীর্ঘ হওয়ায় সেই পূর্বাভাস আর টিকেনি। এছাড়া ২০২০ সালে দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠানগুলো ৬.৭ শতাংশ কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রায় ২০ কোটি পূর্ণকালীন কর্মজীবী মানুষ চাকুরী হারা আজ।
অর্থনীতিতে মন্দা ও মহামন্দা এর আগেও এসেছে। দীর্ঘ সময় অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক মহামন্দার কারণে মহাবেকারত্ব, মহামারি, অবশেষে পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর জন্য বেকারত্ব মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। করোনায় বিশ্বের ছোট, বড় এবং মাঝারি সব ধরনের শিল্পই ক্ষতিগ্রস্ত। এই ক্ষত সারিয়ে নিতে অনেকেই কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ফলে পৃথিবীতে বিশাল বেকারত্ব দেখা যাচ্ছে। বেকারত্বের কারণে সৃষ্ট সমস্যা সামাল দেয়া তাৎক্ষণিক সম্ভব না। বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, যা বছরের পর বছর চেষ্টার ফল। ইকোনোমিক ডিপ্রেশন ও রিসেশনের ফলে অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়ে সেটি হলো বেকার সমস্যা। মানুষ তাতে ক্রয় ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে চাহিদা যোগান কমে যায়। মানুষের আয় কমলে তার দৈনন্দিন ভোগ চাহিদা, সঞ্চয়ও পাশাপাশি অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি কমে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২ কোটি ২২ লাখ নাগরিক বেকার ভাতা দাবি করেছে। এ থেকেই বোঝা যায়, বেকারত্বে হার কতখানি হুমকিস্বরূপ।
চলমান সংকট নিরসনে কৃষি আমাদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন। আমাদের যদি খাদ্য আমদানি করতে হয় তাহলে টাকা থাকলেও অন্য দেশ থেকে খাবার আনতে পারব না। আমাদের দেশে এখনও প্রায় ২ কোটি মানুষ একদিনের আয় দিয়ে একদিনের খাবার যুগিয়ে থাকে। তাদেরকে যদি ২-৩ মাস কোনো কাজ দেয়া না হয়, তাহলে সে যে ধরনের পেশাতেই থাকুক না কেন, সে তো কর্মহীন হয়ে যাবে বা গেছে। তাদেরকেও খাবার দিয়ে রাখতে হলে আগে আমাদের দেশে খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করে দেশের এ সকল মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। এজন্য কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এই মহামারী দীর্ঘ হচ্ছে। কিন্তু এটাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অর্থনীতিকে দ্রুততম সময়ে স্বাভাবিকের দিকে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। বিশ্বে প্রতিদিন করোনা প্রাদুর্ভাবে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পরছে। যার প্রভাবে দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, বাস, ট্রেন ও বিমান চলাচল সব বন্ধ থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া বিশ্ব অর্থনীতির মূল ধাক্কাটা যাবে কর্মী ছাঁটাইয়ের মধ্যে দিয়ে। বৈশ্বিক মহামারীর কারণে চীন, আমেরিকা ও ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন দেশে এই ভাইরাস অর্থনীতিকে ধ্বংসে নামিয়েছে। করোনাভাইরাস মারাত্বকভাবে বিস্তারে স্পেনেও ইতোমধ্যেই চাকুরীর বাজারকে ভয়ানক থাবার শিকারে পরিণত হয়েছে। স্পেনে সরকারি হিসাবে বর্তমানে বেকারত্বের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫ লাখ। এর ফলে আর্থিক বিশ্বমন্দার বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে বলে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতির একটি দিক চাকরির বাজার, যা অর্থনীতিকে পুনর্জীবিত করতে পারে। পরিস্থিতি যদি দ্রুত স্বাভাবিক না হয় তাহলে তা অর্থনীতিকে আরো ক্ষতির মুখে ফেলবে। আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কীভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করবো। কীভাবে চাকরির বাজার সুরক্ষা করবো আর যেখাতগুলো লোকসানের কবলে পড়বে সেগুলোকে কীভাবে পূর্বের জায়গাতে ফিরিয়ে আনবো। আমাদের অর্থনীতির একটি বড় শক্তি গার্মেন্ট খাত যা এখন কোনো রকমে চলছে। পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভর কর্মসংস্থানের একটি বিশাল অংশ। অর্থনীতিকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া এই খাতে রপ্তানি করে আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে বেশির ভাগই পোশাক। অপর দিকে করোনার প্রভাবে ইউরোপ এবং আমেরিকায় রপ্তানিতে প্রভাব পড়েছে। করোনার প্রভাব একসময় স্তিমিত হয়ে আসবে। বিশ্ব চেষ্টা করবে ঘুরে দাঁড়াতে। লক্ষ রাখতে হবে, এই সময়টায় কারও চাকুরী যেন না যায়। কর্মী ছাঁটাই স্থায়ী কোনো সমাধান না। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এই অবস্থা বজায় রাখতে হলে অর্থনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। এমনিতেই দেশের বেকারত্বের সমস্যা দূর করার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েও কিনারা করতে পারছে না। যদি কর্মী ছাঁটাই বৃদ্ধি পায় তাহলে পরিস্থিতি হবে অনেক ভয়াবহ। সরকার বেকারত্বের সমস্যা দক্ষ হাতে সামাল দিতে হবে।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক
Discussion about this post