ফেব্রুয়ারি মাস বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসকে ঘিরে বাঙালী তরুণদের মধ্যে কত কল্পনা কত জল্পনা। সেই কল্পনা জল্পনার তারুণ্য থেকে ভাবনা ও চেতনার কথা বলছে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া কয়েক জন শিক্ষার্থী। সেই ভাবনা কথাচিত্র তুলে ধরেছেন এস. এস. সম্পা দাস গুপ্তা।
অমর একুশে আমাদের অস্তিত্বের নাম
শাবলু শাহাবউদ্দিনঃ
অমর একুশে আমাদের এক অস্তিত্বের নাম। যে অস্তিত্বকে ঘিরে ছবির মত করে ফুটে উঠে আমাদের বাঙালিত্ব, বাংলা এবং বাংলাদেশ। ১৯৫২ সালের এই দিনে আমাদের বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা বুকে তাজা রক্ত দিয়ে পাক বাহিনীকে বুঝিয়ে দিয়ে ছিল আমরা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে কত বদ্ধপরিকর। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শুধু আমাদের ভাষা আন্দোলনের পথ ছবি নয়। এই আন্দোলন ছিল আমাদের মুক্তি আন্দোলন। আমাদের অস্তিত্ব এবং জাতি সত্তা রক্ষার আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে যে মুক্তির বীজ বপন করে ছিল তা ১৯৭১ সালে এসে বৃক্ষ হয়ে জন্ম নিয়ে আকাশের প্রাণে চেয়ে পাক অত্যাচারী সরকারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মুক্তির ডাক দেয়। একুশে এসে ছিল বলেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যূত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং অবশেষে ১৯৭১ সালে স্বাধীন এসে ছিল। তাই অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আমরা আমাদের শরীরের রক্তের সাথে তুলনা করলে ভুল হবে না। আমরা যেমন রক্ত বিহীন অস্তিত্ব হীন। তেমনি অমর একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণ বিহীন আমরা বাঙালি হীন। সুতরাং আমরা সন্দেহ ব্যতীত বলতে পারি, অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের বাংলা ভাষার এবং বাঙালিদের এক অস্তিত্বে নাম।
শাবলু শাহাবউদ্দিন
শিক্ষার্থী
ইংরেজি বিভাগ
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ভাষার অপব্যবহার রোধ করি
কে,এম,ছালেহ আহমদ বিন জাহেরীঃ
আক্ষরিক বিবেচনায় ভাষা শব্দটি ছোট হলেও এর তাৎপর্য অমূল্য কম নয়, কেননা এর সঙ্গে মিশে আছে হাজারো ভাষাপ্রেমী শহীদদের রক্ত, আত্মত্যাগ ও সংগ্রাম।ফেব্রুয়ারি মাস এলেই পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে স্মরণ করি সেই ভাষা-শহীদদের, সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ নাম না-জানা আরো অনেকেই, যাদের তাজা প্রাণ ও রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি মাতৃভাষা। তাদেরই আত্মত্যাগের বিনিময়ে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর, ইউনেস্কো থেকে ঘোষণা করা হয়, (২১ শে ফেব্রুয়ারী) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দিনটি বাঙ্গালি জাতীর নিকট, আত্মত্যাগ, শ্রদ্ধা ও গৌরবের মাস।
বর্তমানে চলছে সেই ভাষার অবাধ অপপ্রয়োগ। ভিনদেশি সংস্কৃতিচর্চায় হারীয়ে যাচ্ছে নিজস্ব ভাষাগত ঐতিহ্য।
প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে অতিমাত্রায় ইংরেজি ভাষাকে। দেশের বিভিন্ন কর্মকান্ড, বাড়ির নাম, দোকানের নামফলক, ডাক্তারের ব্যবস্থাপনা, অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র ইত্যাদি লেখা হয় ইংরেজিতে।
এভাবে চলছে ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, ফারসির মিশ্রণে বাংলা ভাষার ব্যবহার। আধুনিকতার নামে, নানা রকমের শব্দ ব্যবহারে, সুকৌশলে অবহেলা করা হচ্ছে বাংলা ভাষাকে। হচ্ছে দূষিত ও বিকৃত। ভাষা ব্যবহারে এমন অবহেলা খুবই হৃদয়বিদারক।
মায়ের কাছে শেখা ভাষা মায়ের মতোই পবিত্র। সুতারাং মাতৃভাষার সম্মানে ভাষার অপপ্রয়োগ বা ভাষাকেন্দ্রিক অবহেলা দূরীকরণের মাধ্যমে, প্রাণের বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের।
লেখকঃ কে,এম,ছালেহ আহমদ বিন জাহেরী
শিক্ষার্থীঃ মৌকারা ডিএসএন কামিল মাদ্রাসা। নাঙ্গলকোট,কুমিল্লা।
একুশে চেতনা ধারণ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে
রাতিক হাসান রাজীবঃ
একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস। একই সাথে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষকে দুইভাগ করলে আমাদের জোরে দেওয়া হয় পাকিস্তানের সাথে। তারা আঘাত আনে ভাষার উপর। পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষা বাংলা হওয়ার সত্ত্বেও তারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কিন্তু বাঙালি তা মেনে নেই নি। তারা আন্দোলনে নেমে পড়ে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের পরিকল্পনা করলে পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। এতেও দমাতে পারি নি ছাত্রসমাজকে। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ করলে পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে । এতে রফিক,জব্বার, বরকত, অহীউল্লাহ প্রমুখ শহীদ হন। ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাঙালির জাতিসত্তায় যে চেতনার জন্ম হয়েছিল তা এক অবিনাশী চেতনা। এই চেতনা আমাদের দিয়ে আসছে অন্যায় ও অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শক্তি ও প্রেরণা। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালির যে আত্মসচেতনতা ও আত্মপরিচয়ের উদ্ভব ঘটেছিল তার পথ ধরে ‘৫৪ এর নির্বাচন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন এবং ‘৭১ এ আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই অবিনাশী চেতনাকে ধারণ করে আমাদের যেতে হবে এগিয়ে।
রাতিক হাসান রাজীব
শিক্ষার্থী,
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,সিলেট।
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রেরণা
শাহ মোঃ আশরাফুল ইসলামঃ
ভাষা আন্দোলন বাঙালি বা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম বিপ্লব। এই আন্দোলন আমাদের জাতীয়তাবাদের প্রতীক। এই আন্দোলন প্রমাণ করেছিলো শুধু ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের জীবন,সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে না। একসাথে বসবাস করতে হলে ভাষাগত,আত্মিক,মানবতা,আদর্শিক সাদৃশ্য থাকা বাঞ্চনীয়। একইসাথে মাতৃভাষার অধিকার,সম্মান রক্ষার্থে রক্তস্রোতে ভাসা রাজপথে নিজেদের জীবন বিলিয়ে পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দিলো যে প্রত্যেক ভাষার সম্মান দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই অনন্য দৃষ্টান্ত পৃথিবীর বুকে মাতৃভাষার সম্মানে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে যাতে আর কোনও শাসক কোনও ভাষার অধিকার খর্ব করতে না পারে। যারা ভাষার সম্মানহানী করতে চাইবে তাদের বিরুদ্ধে বুলেটের সামনে বুক পেতে লড়াই করতে হবে। তবে বাঙালির কাছে এই বিপ্লব কেবল ভাষার অধিকারের বিপ্লব নয় এই বিপ্লব পরবর্তী সকল আন্দোলনের প্রেরণা! ১৯৫২ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত যত আন্দোলন হয়েছে ছাত্র সমাজ প্রত্যেকটি আন্দোলনে ভাষা আন্দোলনকে উৎসাহের বীজ মেনে সামনে এগিয়েছে এবং ভবিষ্যতে যত অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই হবে সেখানেও ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য কমবে না।
শাহ মোঃ আশরাফুল ইসলাম
শিক্ষার্থী,শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,সিলেট
শুদ্ধ বাংলা চর্চা জরুরী
মো. নাজমুচ্ছাকিবঃ
১৯৪৭ সালে ভারত বর্ষ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পাকিস্থান ও হিন্দুস্থান{ভারত} নামে স্বাধীন দুটি দেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আমাদের এই বাংলাদেশ তৎকালীন পাকিস্থানের অংশ ছিল। পাকিস্থানের জান্তা শাসক গোষ্ঠি আমাদের দেশের মানুষের উপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। আমাদের মাতৃভাষা কেড়ে নিতে চায়। আমাদের দেশের দামাল ছেলেরা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুরায়ি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মাতৃভাষাকে রক্ষা করেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা কি সেই মাতৃভাষা কে রক্ষা করতে পেরেছি? আজ আমরা বাংলা ভাষার মাঝে ইংরেজি ভাষার মিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন আরেকটি ভাষা বানিয়ে ফেলতেছি। আজ আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলে ১০ শব্দের একটা বাংলা বাক্য বললে তার মাঝে ৩/৪ টা ইংরেজি শব্দ রাখে যা মোটেও কাম্য নয়। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে আমরা বাংলাকে ইংরেজি বর্ণমালাতে লিখতেছি তাহলে আমাদের ভাষার এই ৫০ টা বর্ণ কি দোষ করল?
২০২২ সালে মাতৃভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। আমরা এই বছর প্রত্যেকেই এই বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে, আর আমরা আমাদের ভাষায় অন্য ভাষার মিশ্রণ ঘটাব না এবং বাংলা ভাষাকে অন্য ভাষার বর্ণমালা দিয়ে লিখব না। তবেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের সার্থকতা হবে।
মো. নাজমুচ্ছাকিব
শিক্ষার্থী
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
অমর চেতনায় একুশে
রেদওয়ান আহমদঃ
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের এক চেতনার নাম। যার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য। ১৯৫২ সালের এই দিনে ভাষা শহীদেরা তাদের বীরত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব না দেখালে আজ হয়তো আমরা একটি স্বাধীন দেশের স্বাদ পেতাম না। সেজন্য, একুশ আমাদের এক জাতীয়তাবাদী চেতনার নাম। তবে, দেশ এখন বহুমাত্রিক সংকটে পতিত। আমরা আমাদের একুশের চেতনা মনে মনে বিশ্বাস করি, কিন্তু সে চেতনার চর্চা করি না। দিনদিন আমরা বিদেশি সংস্কৃতির দিকে ধাবিত হচ্ছি তো হচ্ছিই, সেইসাথে নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতিটাকেও দূরে ঠেলে দিচ্ছি। ভাষা আন্দোলনের এত বছর পরেও আমরা বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে পারিনি। অথচ, ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার প্রধান সোপান। বর্তমানে দোকান-পাট, কোর্ট-কাচারি, অফিস-আদালত, সর্বত্রই দেখ মিলে বাংলা ভাষার অপব্যবহার। যা একুশের চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। রেডিও-টিভি, নাটক-সিনামায়ও চলছে অবাধে বাংলা ভাষা বিকৃতি। এসব সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে ধীরে ধীরে বাংলা ভাষা হয়ে পড়বে সম্পূর্ণ স্বকীয়তাহীন। বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বা হবে প্রশ্নবিদ্ধ। সেই সাথে আমরা হারিয়ে ফেলব বাঙালি জাতির হাজার বছরের পুরনো সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
রেদওয়ান আহমদ
শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post