শাবলু শাহাবউদ্দিনঃ
ফেব্রুয়ারি মাস আসলে আমাদের মনে পরে বাংলা ভাষার সেই সংগ্রামী দিনের কথা। মনে পরে ভাষা শহীদের রক্তের কথা। মনে প্রাণে আমরা বাঙালি হওয়ার চেষ্টা করি। বাংলা ভাষাকে তুলে ধরতে এক মাস ব্যাপি চলে বই মেলার আয়োজন। ফিরে আসে আবেগ। ফেব্রুয়ারি চলে গেলে চলে যায় আমাদের আবেগ। বিনাশ হয়ে যায় আমাদের বিবেক। যে ভাষার জন্য শহীদ হলেন বাংলা মায়ের সন্তান, সেই বাংলাতেই স্বীকৃতি পেলো না তাদের আন্দোলন স্মৃতি টুকু। যে টুকু স্মরণ করা হয় সেটাও আবার উপনিবেশিক নামে। বড় অাফসোস হয়। সংগ্রামী দিন টাকে আমরা স্মরণ করি ২১শে ফেব্রুয়ারি নামে। এই ফেব্রুয়ারি কী আমাদের বাংলা মাস? আসলে দিনটি স্মরণ করা উচিত ছিল ৮ই ফাল্গুন নামে। কারণ সেই দিনটি ছিল ৮ই ফাল্গুন। এখানেই শেষ নয়। বাংলা মাস উপলক্ষ্যে যে বই মেলার আয়োজন করা হয় সেখানে বাংলা ভাষার বইয়ের চেয়ে বেশি বিক্রি করা হয় বিদেশী ভাষার বই। বিশেষ করে ইংরেজি। আমাদের মধ্যে উপনিবেশিক আজও আকরিয়ে ধরে রেখেছে। তাই আমাদের দেশে ইংরেজি বাধ্যতামূলক ভাবে পড়তে হয়। এই দেশ থেকে উচ্চতার ডিগ্রী অর্জন করতে হলে আপনাকে ইংরেজি জানা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চলে ইংরেজি ভাষায়। সরকারি অধিকাংশ কাজ চলে ইংরেজি ভাষা। বিচার কার্যক্রম ইংরেজি ভাষায়। সংস্কৃতি সংঘ গুলো নাম এবং কার্যক্রম চলছে ইংরেজি ভাষা। এমনকি যে সংস্থা বাংলা ভাষাকে নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে তার অর্ধেক নাম ইংরেজি শব্দে। এটা যেমন আফসোসের তেমনি হাস্যকরও বটে। যে দেশে ৯৮% মানুষ বাঙালি সেদেশে এমন হতে পারে না। এটা আমাদের প্রত্যাশা নায়। আমাদের প্রত্যাশা বাংলাদেশ সকল কাজে কর্মে ১০০% বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা হোক।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের একবছর পর ১৯৪৮ সালে বাংলা নিয়ে সৃষ্টি হয় জটিলতা। সেই জটিলতার জের ধরে ১৯৫২ সালে অনেক মায়ের বুক খালি হয়। তারিখটা ছিলো আটই ফাল্গুন রোজ বুধবার ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ। কিন্তু সেই আট ফাল্গুন আমরা চিনি না, চিনি একুশে ফেব্রুয়ারিকে। বিষয়টি কিন্তু জাতীয়ভাবে লজ্জাজনক। সেই সংগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করা। বাংলা ভাষা যেহেতু আমাদের মাতৃভাষা ছিলো তাই আমরা চেয়ে ছিলাম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিক তৎকালীন সরকার এবং প্রশাসন। ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষা লিখিত আকারে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেলেও, সেই বাংলা ভাষায় আজো সঠিকভাবে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা কী পেয়েছে! পেলেও কতটুকু পেয়েছে, প্রশ্ন কিন্তু থেকে যায় ।
এখনো বিচার কার্যক্রম চলে ইংরেজি ভাষায়, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নোটিশ দেওয়া হয় ইংরেজি ভাষায়, যে কোনো আবেদন ফর্ম পূরণ করতে হয় ইংরেজি ভাষায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগের বইগুলো পড়ানো হয় ইংরেজি ভাষায়, চাকরির আবেদন ফর্ম পূরণ করতে হয় ইংরেজি ভাষায়, সরকারি-বেসরকারি সকল চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজি গুরুত্ব সবার প্রথমে, সরকারি-বেসরকারি সব বড় প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র তৈরি হয় ইংরেজি ভাষায়, এখনো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের নাম ইংরেজি ভাষায় (যেমন ইসি, বিআরটিসি, বিআর, বিআরআরআই, ইউজিসি, এনবিআর, এমসিসিআই ইত্যাদি)।
বাংলা ভাষার মর্যাদা কেবল মুখের বুলি হিসেবে থাকলে চলবে না। এখন এদেশের ৯৮% মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। যেদেশে চাকরি খুঁজতে হলে ইংরেজি ভাষা জানা অপরিহার্য। একজন অফিস সহায়কের চাকরির পরীক্ষায় থাকে চারভাগের একভাগ ইংরেজি। বিষয়টি কিন্তু খুব চিন্তার, একজন অফিস সহকারী ইংরেজি ভাষা জানা কেনো এত গুরুত্ব? যে দেশের ৯৮% লোকের মুখের ভাষা বাংলা। সেই দেশের সরকারি-বেসরকারি সব পরীক্ষার ২৫% অধিক কেনো প্রশ্ন করতে হবে ইংরেজিতে। যে কোনো চাকরির পরীক্ষার মৌখিক পরীক্ষার প্রথম প্রশ্ন থাকে, introduce yourself । কিন্তু কেনো এই প্রশ্ন? যেদেশের ৯৮% লোকের মাতৃভাষা বাংলা, সেদেশের মৌখিক পরীক্ষা প্রশ্ন কেনো ইংরেজি দিয়ে শুরু করতে হবে। ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা, তার মর্যাদা আছে। তাই বলে বাংলা ভাষাকে অপমান করে ইংরেজি ভাষাকে বুকে আকড়িয়ে নিতে পারি না। পৃথিবীতে সীমিতসংখ্যক জাতি তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য জীবন দিয়েছেন। তাদের মধ্যে আমরা অন্যতম। যে ভাষার জন্য জীবন দিলাম, সংগ্রাম করলাম, সেই ভাষার আজ এই দুরবস্থা। দেখে নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা লাগে। সমগ্র বিশ্বের সকল ভাষাভাষীর অবস্থানে দিক দিয়ে বাংলা ভাষা ষষ্ঠতম। কিন্তু সেই ভাষা আন্তর্জাতিক ময়দানে যতটুকু সম্মান পাওয়ার কথা, ততটুকু পেয়েছে কী? নিশ্চয়ই পায় নাই। এর জন্য দায়ী কারা? আমরা নিজেরা। বাংলাদেশ সরকার এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সরকার। আমরা কিন্তু নিজেরা কিন্তু বাংলা ভাষাকে কতটুকু অপমান করছি তা কিন্তু নিজেরা জানি না। আমাদের জানা উচিত নয় কী?
পশ্চিমবঙ্গ সরকার, বাংলাদেশ সরকার, আসাম ও ত্রিপুরা সরকারের এখন বুঝা উচিত বাংলা ভাষার মর্যাদা কতটুকু। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো উচিত বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরা। বর্তমানে যদি আমরা বাংলা ভাষা নিয়ে চিন্তা করতে ভুলে যাই অদূর ভবিষ্যতে আমাদের বাংলা ভাষার অবস্থা খুব খারাপ হবে। বাংলা ভাষাকে সঠিক মর্যাদা দিতে সব স্থানে বাংলা ভাষার চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। যেমন সরকারি-বেসরকারি সকল কাগজপত্র বাংলা ভাষায় হতে হবে, সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার চর্চা কেন্দ্র থাকতে হবে, বইপত্রের অনুবাদে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হবে, সবধরনের বিদেশি ভাষার আগ্রাসন রুখে দিতে হবে। সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার চর্চা কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে সবকিছুর নাম বাংলায় লিখতে হবে এবং রাখতে হবে। সবধরনের নাটক ও চলচ্চিত্রের নাম বাংলায় দিতে হবে এবং শব্দের মিশ্রণ বন্ধ করতে হবে ইত্যাদি।
বাংলা ভাষার ব্যবহার জাতীয় পর্যায়ে বৃদ্ধি করে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষার চর্চা বৃদ্ধি করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাসহ নানা ধরনের পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। পরিশেষে বলা যায় বাংলা ভাষার সঠিক মর্যাদা দিতে হবে।
শাবলু শাহাবউদ্দিন
ইংরেজি বিভাগ
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post