মাদক বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছেয়ে গেছে মাদকের ভয়াবহতা। সমাজ তথা দেশকে এগিয়ে নিতে যেমন যুবসমাজের বিকল্প নেই। কিন্তু সেই যুবসমাজ ধ্বংসের অন্যতম হাতিয়ার মাদক। বর্তমান সমাজ ও দেশের জন্য মাদকাসক্তি মহামারী সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। বৃদ্ধ থেকে শুরু করে যুবক হাজার হাজার মানুষ এ মরণ নেশায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।
বিশেষ করে, যুবসমাজের অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। যুবসমাজকে এ মরণ নেশা থেকে রক্ষা করা না গেলে এ হতভাগ্য জাতির পুনরুত্থানের স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। মাদকাসক্তি একটি স্নায়ুবিক ক্রিয়া। এর প্রভাবে ব্যক্তির চিন্তা -চেতনা ও আচার -আচরণে অসংগতি পরিলক্ষিত হয়। মাদক দ্রব্য গ্রহণের ফলে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পাড়ে। যার ফলশ্রুতিতে মনের অনুভূতি ও চিন্তা -চেতনা স্বাভাবিক অবস্থা থেকে অস্বাভাবিক অবস্থায় রুপান্তর হয়।মাদকাসক্তির শুরুটা ধুমপান দিয়ে হলেও পরবর্তীতে গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা, আফিম, হেরোইন, অ্যালকোহলসহ যাবতীয় মাদকের আসক্ত হয়ে পড়ে। এসব মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে সাময়িক যৌন উত্তেজনাসহ মানুষ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।তখনই ঘটে চুরি, ডাকাতি,ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানান সন্তাসী কর্মকাণ্ড। সমাজে সৃষ্টি হয় নৈরাজ্য আর বিশৃঙ্খলা। পরিবারগুলোতে নেমে আসে বিশৃঙ্খলা আর অশান্তি। অপরদিকে যৌন উত্তেজনা প্রশমিত করতে গড়ে তুলে অনৈতিক সম্পর্ক। যা নৈতিকতার চরম অবনতি।
করোনার কারণে হঠাৎ করে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। করোনা পরিস্থিতি অবনতির কারণে ধপায় ধপায় বাড়ানো হয় বন্ধের সময়সীমা। শিক্ষার্থীরা ছিটকে পড়ছে সাধারণ শিক্ষা কার্যক্রম থেকে। ওই দিকে শিক্ষার্থীরা বাসায় থেকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে হাতছানিতে ভেঙে পড়ছে। জড়িয়ে পড়ছে মাদকাসক্তির দিকে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর তথ্য মতে, দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। এদের মধ্যে ১২ বছর থেকে ১৮ বছরের মধ্যে ০.৮ শতাংশ। ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে ০.২ শতাংশ এবং ১৮ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে ৬.৯ শতাংশ মানুষ মাদক ব্যবহারে প্রকোপ রয়েছে। দেশের বিভাগীয় জায়গায় মাদকাসক্তি প্রবল বেগে বেড়ে চলছে। বিভাগ অনুযায়ী মাদক ব্যবহারকারী সবচেয়ে বেশি রয়েছে ঢাকা বিভাগে ৩৬ দশমিক ৮০ শতাংশ। এরপর চট্টগ্রাম বিভাগে ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। এ ছাড়া রংপুর বিভাগে ১৩ দশমিক ৯০, রাজশাহী বিভাগে ৭ দশমিক ১০, সিলেট বিভাগে ৬ দশমিক ৯০, খুলনা বিভাগে ৬ দশমিক ২০ এবং সবচেয়ে কম ছিল বরিশাল বিভাগে ৪ দশমিক ১০ শতাংশ। সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়, মাদকের প্রকার অনুসারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় গাঁজা ৮২ দশমিক ৯০ শতাংশ, অ্যালকোহল ২৭ দশমিক ৫০, ইয়াবা ১৫ দশমিক ২০, অপিয়ড ৫ দশমিক ৩০ এবং ঘুমের ওষুধ ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। পুরুষের মধ্যে মাদক ব্যবহারকারী ৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং নারীদের মাঝে দশমিক ৬ শতাংশ। এ ছাড়া মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ গুলো হলো-১.বেকারত্ব ও কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থতা। ২.সমবয়সীদের চাপ; ৩.মাদকের সহজলভ্যতা; ৪.আর্থসামাজিক অস্থিরতা; ৫.মাদকের কুফল সম্পের্ক অজ্ঞতা; ৬.ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়; ৭.পারিবারিক কোলাহল; ৮.অর্থিক অনটন; মানসিক অশান্তি; ৯.রাজনৈতিক ছত্রছায়া;১০.বিচ্ছেদ ইত্যাদি। আবার অনেকে কৌতূহল মেটাতে বন্ধুদের পাল্লায় পরে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।
মানবসম্পদ উন্নয়নের মাদক বড় অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে। মাদক গ্রহণে শুধু মানসিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হয় তা নয় শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মাদক সেবনের ক্ষতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হল শারীরিক ক্ষতি। মাদক সেবনে যে সকল দৈনিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় তা হলো- হৃদযন্ত্রের কার্যকরীতা কমে যায়,শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। জন্ডিস, হেপাটাইটিস, লিভার সিরোসিস, ক্যন্সারসহ নানান জটিল রোগ দেখা দেয়। হজম শক্তি কমে যায়,আলসার, এসিডিটি,কোষ্ঠকাঠিন্য সহ ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে যৌন ক্ষমতা কমে যায়। মাদকাসক্ত ব্যক্তির আরেকটি অন্যতম সমস্যা হলো মানসিক ভারসাম্যহীন। স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মায়ের সাথে উগ্র আচরণ। সামাজিক কার্যক্রম এড়িয়ে চলা।প্রিয় মানুষদের সাথে সময় না দেওয়া ইত্যাদি। মাদকাসক্তির আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে পারিবারিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা। যদি কোন পরিবারে মাদকাসক্ত ব্যক্তি থাকে, সে পরিবারে কোন সুখ, শান্তি থাকেনা। মাদক কেনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ- জোগান দিতে না পারলেই লেগে যায় মারামারি, ঝগড়া এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ। এমনো হয় যে টাকার জন্য পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলা পর্যন্ত হয়। যা অন্তত দূখঃজনক ও লজ্জাস্কর। গবেষনায় দেখা গেছে, প্রায় ক্ষেত্রে হতাশা ও দুঃখবোধ থেকে সাময়িক স্বস্তিলাভের আসা থেকেই মারাত্মক নেশা এমন বিস্তার লাভ করেছে। পাশাপাশি এ কথা সত্য যে, কিছু বিপদগামী মানুষ ও বহুজাতিক সংস্থা অর্থের লালসায় বেছে নিয়েছে রমরমা মাদক ব্যবসার পথ।বাংলাদেশ সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি রেখে নানা ধরনের অভিযান চালাচ্ছেন। কিন্তু এর পরেও মাদকের বিস্তার যেন কমছেই না।
মাদক ব্যবসায়ী তথা রাঘববোয়ালদের না ধরা পর্যন্ত মাদকের বিস্তার কমানো সম্ভব না। মাদক প্রতিরোধে পরিবার ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে হবে। পারিবারিক সচেতনতা, শিক্ষা, পরিমিত জীবন যাপন, বন্ধু নির্বাচনে সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। মাদকের অর্থ জোগানদাতা, পৃষ্ঠপোষক,মদতদাতা, সেবনকারী ও বহনকারীর অপরাধ ভেদে পরিমাণ বাড়িয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড ও ১ কোটি টাকা জরিমানা বিধান আছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে,অনেকাংশেই এই আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মাদকের সরবারাহ বন্ধ করতে সীমান্তে কঠিন ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি মাদক চোরাচালানিদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমকে বলিষ্ঠ ভুমিকা পালন করতে হবে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের খেলাধুলা সহ বিভিন্ন সামাজিক কাজে উৎসাহিত করতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষা কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুর্নবাসন নিশ্চিত করতে হবে।
সর্বোপরি, যার যার অবস্থান থেকে দেশপ্রমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মাদক প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে মাদক মুক্ত দেশ গড়া সম্ভব।
লেখকঃ হাচান মাহমুদ শুভ
শিক্ষার্থী,(এমবিবিএস ১ম বর্ষ) ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ,গাজীপুর ।
Discussion about this post