মো. আমিনুল ইসলাম, ঝালকাঠি সংবাদদাতা:
প্রয়োজনীয় সকল যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থা থাকার পরেও শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞ সার্জনের অভাবে প্রায় ১৪ ধরে বন্ধ রয়েছে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অপারেশন থিয়েটার। যারফলে উপজেলাবাসী স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি থিয়েটারের মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও মালামাল ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পরার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সরেজমিনে নলছিটি হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে অপারেশন থিয়েটার সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি কক্ষে তালা ঝুলছে। জরুরী প্রসূতি সেবাসহ (ইএমওসি) সকল ধরণের অপারেশন( অস্ত্রপচার) কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
এতে উপজেলার সাধারন জনগনের দুর্ভোগ চরমে পৌছেছে। মৃত্যুঝুঁকিসহ সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন প্রসূতি মায়েরা। ফলে অতিরিক্ত অর্থের মাধ্যমে বিভিন্ন বেসরকারী ক্লিনিকে তাদের চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। যা গরীব মানুষদের জন্য দ্রব্যমূল্যের এই বাজারে প্রায় অসম্ভবই হয়ে দাড়িয়েছে। যারা সহায় সম্বল বিক্রি করে অথবা ঋণের টাকায় চিকিৎসা নিতে পারছেন তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন আর যারা পারছেন তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে ভাগ্যের উপর।
জানাগেছে, জরুরী প্রসূতি সেবা কেন্দ্রটি চালু থাকলে প্রসূতি মায়েরা বিনা খরচে নিরাপদে এখান থেকে চিকিৎসা সেবা নিতে পারতেন। মাসে ২০ থেকে ২৫ টি সিজারিয়ান অপারেশন অনায়াশেই চালানো যেতো । অসহায়, গরীব রুগীদের বিনা খরচে সিজারিয়ান অপারেশন করানোর একমাত্র ভরসা ছিল উপজেলা পর্যায়ে ঝালকাঠি জেলার নলছিটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একমাত্র এ জরুরী প্রসূতি সেবা কেন্দ্রটি।২০১২ সালের ১৩ আগস্টে আধুনিক সেবা সহ ৩১ সয্যা থেকে ৫০ সয্যায় উন্নীত করে হাসপাতালটির নতুন ভবনের উদ্বোধন হয়।
হাসপাতালসূত্রে জানাগেছে, বিশেষজ্ঞ সার্জন ডাঃ মাহবুব হোসেন ও অ্যানেস্থেসিয়া (অচেতন) চিকিৎসক ২০০৯ সালের জুলাই মাসে বদলি হয়ে যাওয়ার পর এ যাবৎ কোন বিশেষজ্ঞ সার্জন ও অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক এখানে যোগদান করেননি। ফলে বিশেষজ্ঞ সার্জন ও অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসকের অভাবে একযুগ ধরে বন্ধ রয়েছে নলছিটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরী প্রসূতি সেবাসহ সকল ধরণের অপারেশন । এ অবস্থায় সিজারিয়ান অপারেশন প্রয়োজন এমন প্রসূতিদেরকে নিতে হচ্ছে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে । আবার ক্লিনিক সমূহে তাদের সার্জনের অপারেশন চার্জ, ওষুধ ও ক্লিনিক ভাড়াসহ ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। এ অবস্থায় অসচ্ছল পরিবারের প্রসূতিরা অস্বাভাবিক ডেলিভারীর কথা জেনেও ভাগ্যের ওপর ভরসা করে ঝুঁকি নিয়ে ভর্তি হচ্ছে এ হাসপাতালটিতে।
সেখানে ডাক্তার ও নার্সরা নরমাল ডেলিভারী করাতে ব্যর্থ হলে বিশেষজ্ঞ সার্জন না থাকায় প্রসূতি ও শিশুর জীবন বাঁচাতে স্বজনরা তখন নিরুপায় হয়ে ধার-দেনা করে তাদেরকে বরিশাল নিতে বাধ্য হচ্ছেন। পথিমধ্যে প্রান হারিয়েছেন প্রসূতি মায়েরা এরকম নজিরও রয়েছে।
২০২১ সালের ১৩ নভেম্বর হাসপাতালে নরমাল ডেলিভারির জন্য আনা উপজেলার কুশংগল গ্রামের এক প্রসূতি নারীর সন্তান প্রসবের সময় গলায় কর্ড(নারি) পেচিয়ে পরলে দ্রুত অপারেশনের প্রয়োজন দেখা দিলেও সেটি অচল থাকায় সেই শিশুর মৃত্যু হয়। এরপর জনমনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হলে তারা অপারেশন থিয়েটার চালুর দাবিতে সেই বছর ২৩ নভেম্বর মানববন্ধন করেন।
হাসপাতালটিতে অপারেশন থিয়েটার এবং সকল পরীক্ষা নিরিক্ষা চালুর দাবিতে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া স্থানীয় সমাজকর্মী বালী তূর্য বলেন,আমরা ২০২১ সালের মার্চ মাসে অপারেশন থিয়েটার, আল্ট্রাসনোগ্রাম সহ সকল পরীক্ষা নিরিক্ষা চালুর দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছিলাম। এরপরে মানববন্ধন করেছি, প্রচুর সংবাদ প্রচার করা হয়েছে, জেলার সিভিল সার্জন এর কাছে গিয়েছি,স্থানীয় সংসদ সদস্য মহোদয়ের বাসায় গিয়েছি সবাই আস্বাস দিলেও বাস্তবে দুই বছর পেরিয়ে গেলেও কিছুই চালু হয়নি।সরকারি ফি ২৩০ টাকায় এখানে আলট্রাসনোগ্রাম করানো যেত,কিন্তু নতুন মেশিনও বিকল হয়ে থাকায় মানুষ সেই সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে ১০০০-১১০০ টাকায় ক্লিনিকে করাতে বাধ্য হচ্ছেন। এটা মেনে নেয়া যায় না। দ্রুত এই সেবা চালু না হলে আমরা আরও কঠোর আন্দোলন করবো, সরকার এখানে যন্ত্রপাতির পেছনে রাজস্বের অর্থ খরচ করেছে অথচ মাত্র দু জন চিকিৎসকের অভাবে সেই কোটি কোটি টাকা নস্ট হয়ে যাবে তা মেনে নেয়া যায় না।
আরও জানা গেছে, নলছিটি স্বাস্থ্য কমল্পেক্সে স্বল্পতা রয়েছে সাপে কাটা রোগীর এন্টিভেনম,জলাতঙ্ক সহ বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনের। কিছু দিন আগে স্থানীয় বাসিন্দা জসিম হাওলাদারের মেয়েকে পোষা বিড়াল আচঁড় দিলে তাকে টিকা নিতে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে যেতে হয়েছে। তাতে তার সময়ের অপচয় ও ভোগান্তি দুটোই পোহাতে হয়েছে।
স্থানীয় আরেক আন্দোলনকারী নেতা এফ এইচ রিভান জানান, অপারেশন থিয়েটারের কার্যক্রমসহ জরুরী প্রসূতি সেবা ফের চালু হওয়া একান্ত প্রয়োজন। এ সেবা বন্ধ থাকায় এলাকাবাসীর শুধু টাকার অপচয় না প্রসূতি মায়েরা জীবন হারানোর পাশাপাশি নানা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। নলছিটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরী ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞ সার্জন(গাইনী অপারেশন) পোষ্টিং দিয়ে জরুরী প্রসূতি সেবাসহ সকল অপারেশন কার্যক্রম চালু করার দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।
উপজেলা স্বাস্থ্য প.প কর্মকর্তা ডাঃ শিউলি পারভীন জরুরী প্রসূতি সেবাসহ সকল ধরণের অপারেশন কার্যক্রম বন্ধ থাকার কথা স্বীকার করে তিনি জানান, বিশেষজ্ঞ সার্জন ছাড়াতো অন্য কেউ ঐ সেবা দিতে পারবে না। সিজারিয়ান অপারেশন না করতে পারায় এলাকার প্রসূতিরা নানা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। জেনারেল সার্জন, গাইনী সার্জন, অর্থপেডিক্স সার্জনসহ কোনো বিশেষজ্ঞ সার্জন না থাকায় আমি এখানে যোগদান করার পরই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এ বিষয় লিখিতভাবে জানিয়েছিলাম। তারা বেশ কয়েকজনকে দিয়েছিলেন কিন্তু মফস্বল শহর হওয়ায় এখানে কোন চিকিৎসক যোগদান করতে চান না।
Discussion about this post