শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটা। চারদিকে দিনের আলোকে ঘিরে ধীরে ধীরে অন্ধকার গ্রাস করে ফেলছে। প্রকৃতির গাছপালা ও পাখিগুলো সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। পশ্চিম ও পূর্বের আকাশ টকটকে লাল দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে কারো শরীরের তাজা রক্ত নিয়ে হলি খেলায় মেতে উঠেছে।
বন্ধুদের সাথে ক্যাম্পাসে বের হলাম। মুল ফটক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম এবং অন্যরকম অনুভব করতে লাগলাম। প্রকৃতির ঠান্ডা বাতাসে মন ও শরীরকে প্রশান্তি ও সুখের সাগরে ভাসাতে লাগলাম। দক্ষিণ দিকে হাটা শুরু করলাম। পূর্বে মুক্তমঞ্চ লাল হলুদ ইটের স্তরে সাজানো। তার উপর কপোত-কপোতিরা প্রেম বিনিময়ে ব্যস্ত। প্রকৃতির বাস্তব জগতের লিলা দেখতে দেখতে সামনে যেতেই এক বন্ধু পিছন থেকে চিৎকার করে উঠলো সাপ। কত্তো বড় সাপ! পাশ থেকে কয়েকজন তাড়াহুড়ো করে ইট পাথরের কংক্রিট নিয়ে সাপের মাথায় মারতে লাগলো। এই পাশবিক নির্যাতনে ব্যর্থ হলে লাঠি দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো।
সাপ হাত-পা বিহীন মাংসাশী এক প্রকার সরীসৃপ প্রাণী। প্রাণী জগতে সাপ কর্ডাটা পর্বের ভার্টিব্রাটা উপপর্বের , রেপটিলিয়া শ্রেণীর সার্পেন্টেস উপবর্গের প্রাণী। স্কোয়ামান্টা বর্গের সকলের মতোই সাপ এক্টোথার্মিক যার অর্থ হল একটি অংশ যাতে অভ্যন্তরীণ তাপ উৎপন্নকারী জৈবিক উৎস রয়েছে।সাপের সর্বমোট ১৫টি পরিবার, ৪৫৬টি গণ, এবং ২,৯০০টিরও বেশি প্রজাতি রয়েছে। আকারে ১০ সে.মি. থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২৫ ফুট বা ৭.৬ মিটার পর্যন্ত হতে পারে।
সাপ বাস্তুতন্ত্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের খাদক,যেমন ছোট ছোট প্রাণী ইঁদুর, ব্যাঙ, খরগোশ ইত্যাদি খেয়ে থাকে। বড় সাপ যেমন অজগর বা অ্যানাকন্ডা অনেক সময় বড় আয়তনের বন্যপ্রাণী হরিণ, শুকর খেয়ে থাকে।সাপ না থাকলে এ প্রাণীদের সংখ্যা অত্যাধিক বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। তখন প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হতো। কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলে সাপের সংখ্যা কমে গেলে সেখানে ফসলের জন্য ক্ষতিকারক জীবজন্তু ও ইঁদুরের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
প্রখ্যাত সংবাদপত্র দ্যা গার্ডিয়ান এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৮ সালে ভারতের মিজোরামে এক প্রজাতির বাঁশগাছে প্রায় ৪৮ বছর পর ফল আসার জন্য ইঁদুরের খাদ্যের প্রাচুর্য দেখা দেয় এবং তাদের অত্যাধিক হারে বংশবৃদ্ধি ঘটে। সেই বাঁশগাছের ফল ইঁদুররা খেয়ে শেষ করে ফেললে তাদের খাদ্যাভাব দেখা দেয়, তারা চাষের জমির ফসল খেয়ে নষ্ট করতে থাকে। এতে প্রায় দশ লক্ষ মানুষ সেই বছর দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়।
আবার, যেসব সাপ মাটির নীচে গর্ত বানিয়ে থাকে তারা চাষের জমির মাটির ভিতর বায়ু প্রবেশ করিয়ে গাছের শিকড়ের বৃদ্ধি বজায় রাখে। জমি যত বায়ুপূর্ণ হয়, গাছের শিকড় তত ভালো বাড়তে পারে। বিষাক্ত সাপের বিষ থেকে বিভিন্ন ধরনের ওষুধও পাওয়া যায়। টক্সিনস জার্নালে বেরনো গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) ইতিমধ্যে সাপের বিষ থেকে তৈরি বেশ কিছু ওষুধের ব্যবহারে সম্মতি দিয়েছে। এই ওষুধগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ক্যাপটোপরিল, ইনটেগরিলিন,এগরেসটেট ইত্যাদি। সাপের বিষ শুধুমাত্র মানুষ মারে এই কথাটা ঠিক নয়, সেটা থেকে জীবনরক্ষাকারী ওষুধও তৈরি হয়। চীন দেশেও প্রাচীনকাল থেকে সাপ ও তার বিষের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। চর্মরোগ, বাতের ব্যাথায় সাপের বিষ ব্যবহারের লিখিত প্রমাণ আছে।
সাপ যেহেতু হিংসাত্মক প্রাণী সেহেতু তা থেকে সতর্কতা ও অবলম্বন করতে হবে। সাপের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাবার পদক্ষেপ সম্পর্কে ড. রাতিন্দ্রনাথ মন্ডল বলেন, সাপের কামড় বেশি হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বর,অক্টোবর মাস পর্যন্ত। কারন এই সময় বৃষ্টি হয়, আর সাপ যে গর্তে থাকে তা পানিতে ডুবে যায়। সাপ তখন শুকনো জায়গা খুঁজে বেড়ায়। এই জন্য মানুষের বাড়ীতে,খড়ের গাদা, কাঠের বা খড়ির স্তুপ, বিছানা এমনকি বালিশের নিচেও আশ্রয় নিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, কিছু জিনিস খেয়াল করলে সাপের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বাড়ির আশেপাশে খড়ের গাদা, কাঠের স্তুপ, ইটের স্তুপ না রাখা।বাড়ির চারপাশে কাঁচা রসুন বা ন্যাপথোলিন ছিটিয়ে দেয়া। বাড়ির মধ্যে বা পাশে কোন ভাবেই যেন ইঁদুর, ব্যাঙ আসতে না পারে। লাইট জালিয়ে ঘরে প্রবেশ করুন।খড়ের গাদা থেকে খড় বা খড়ির স্তুপ থেকে খড়ি নেবার আগে কোন কিছু দিয়ে শব্দ করে তারপর খড় নেওয়া। মানুষের থাকার জায়গার আশে পাশে হাস বা মুরগীর থাকার জায়গা না রাখা। রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারী টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে।ঘরের বাইরে বা বারান্দায় না ঘুমানোই। গর্তেই ভিতরে হাত না ঢুকানো।
সাপ কামড়ালে আতঙ্কিত হবেন না। সাধারনত শতকরা ৯৬-৯৭ শতাংশ সাপ দংশন হয় অবিষাক্ত সাপ দ্বারা। বিষাক্ত সাপ কামড়ালেও বিষক্রিয়া হয় মাত্র ৫০% ক্ষেত্রে।
যে জায়গায় সাপ কামড় দিয়েছে সে জায়গাটা নাড়ানো যাবে না। ক্রেপ ব্যন্ডেজ দেয়া সবচেয়ে ভাল।কোন ভাবেই রোগীকে ঝারফুক, কবিরাজী, সাপ কাটার জায়গা ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলা এসব করা যাবে না। রোগীকে দ্রুত কাছের হাস্পাতালে নিয়ে যেতে হবে।অবশ্যই রোগীকে সাপ কামড়ানোর সময় থেকে ২৪ ঘন্টা পর্যালোচনা করে তারপর হাসপাতাল থেকে বাসায় নিতে হবে।
সাপ একটি উপকারি প্রাণি। সাপের পোষ্যই পারবে পরিবেশ থেকে ক্ষতির পোকামাকড় খেয়ে পরিবেশকে সুদর্শন রাখতে।
লেখকঃ আল-কাউসার আহমেদ
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা।
Discussion about this post