মনিরুজ্জামান মনির,যশোর জেলা প্রতিনিধি:
যশোর জেলায় আশঙ্কাজনক বিষয় হচ্ছে বিগত পাঁচ বছরে খেজুর গাছ কমেছে ৫০ হাজার, গাছি কমেছে দেড় হাজার। গাছ এবং গাছি কমে যাওয়ায় ৫৫ লাখ লিটার রস আহরণ কম হয়েছে। ফলে ১ লাখ ৫০ হাজার গুড়ের উৎপাদনও কমে গেছে। এভাবে ক্রমান্বয়ে ‘হারিয়ে যাচ্ছে যশোরের যশ, খেজুরের রস।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী যশোরে ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৩৫০টি খেজুর গাছ থাকলেও রস সংগ্রহ হয় ৩ লাখ ২১ হাজার ৮২৩টি থেকে। বাকি ১৩ লাখ গাছই রস সংগ্রহের বাইরে আছে। গাছ ছোট হওয়া ও গাছি কমে যাওয়া এর প্রধান কারণ। এর বাইরে
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৯ সালে যশোর জেলায় মোট খেজুর গাছ ছিল ১৬ লাখ ৬২ হাজার ৪৭৫টি। এরমধ্যে ৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৫টি গাছ থেকে রস সংগৃহীত হতো। গাছি ছিলো ৬ হাজার ৮৫০। প্রতিটা গাছ থেকে রস উৎপাদন হয়েছে গড়ে ১২৫ কেজি এবং গাছ প্রতি গুড় উৎপাদন হয় ১৩ কেজি।
২০২০ সালে মোট খেজুর গাছ ছিল ১৬ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫০টি। রস সংগ্রহ হয়েছিল ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৫৬০টি। গাছির সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৭২০ জন। প্রতিটা গাছ থেকে রস উৎপাদন ১২৫ লিটার এবং গাছ প্রতি গুড় উৎপাদন হয় ১২ কেজি।
২০২১ সালে খেজুর গাছ কমে হয় ১৬ লাখ ৫৩ হাজার ২৭৫টি। রস সংগ্রহের গাছের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৫২ হাজার ৪৩৫টি। গাছির সংখ্যা কমে হয় ৫ হাজার ৫৩০ জন। প্রতিটা গাছ থেকে রস উৎপাদন হয় গড়ে ১২০ লিটার এবং গুড় উৎপাদন হয় ১৩ কেজি।
২০২২ সালে মোট খেজুর গাছ আরো কমে হয় ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৫৫টি। আর রস সংগ্রহের গাছের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৫ টি। গাছির সংখ্যা ৫ হাজার ১৫০ জন। প্রতিটা গাছ থেকে রস উৎপাদন ১২০ লিটার এবং গুড় উৎপাদন হচ্ছে ১২ কেজি।
২০১৯ থেকে ২০২৩ এ ৫ বছরে গাছের সংখ্যা কমে হয়েছে ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৩৫০টি। এরমধ্যে রস সংগৃহীত হচ্ছে ৩ লাখ ২১ হাজার ৮২৩ টি গাছ থেকে। গাছির সংখ্যা কমে হয়েছে ৫ হাজার ৫০ জন। প্রতিটা গাছ থেকে রস উৎপাদন হয় গড়ে ১১৪ লিটার, প্রতিটি গাছ থেকে গুড় উৎপাদন হয় গড়ে ১০ কেজি। ৫ বছরে রসের উৎপাদন কমেছে ৫৫ লাখ লিটার এ সময়ে গুড়ের উৎপাদন কমেছে এক লাখ ৫০ হাজার কেজি।
জেলায় সবচেয়ে বেশি রস গুড় উৎপাদন হয় বাঘারপাড়া উপজেলায়। সেখানকার চিত্রও আশঙ্কাজনক। বাঘারপাড়া উপজেলায় পূর্ন বয়স্ক খেজুর গাছ রয়েছে ৫ লাখ ৫৪ হাজার, রস আহরণকারি গাছের সংখ্যা মাত্র ৪৫ হাজার, গাছির সংখ্যা ১ হাজার ৪৫ জন, রস উৎপাদন ৫০ হাজার লিটার।
যশোর সদরের লেবুতলার গাছি অলিয়ার রহমান জানান, যত সমস্যা খেজুর গাছে। দু’বছর আগেও রাস্তা করার সময়ও অনেক খেজুর গাছ মারা পড়ে।
লাউখালী গ্রামের গাছি আব্দুস সালাম জানান, ‘আমার গ্রামের খেজুর গাছ প্রায় শেষ। আমি হাপানিয়া গ্রামের মাঠের খেজুর গাছ কাটি। মোট মাঠ কুড়িয়ে ১’শ গাছে রস হয়। আগের সেই বড় কোন গাছ নেই। বড় গাছে রস বেশি হয়, মিষ্টিও হয়। বড় গাছ না থাকায় রসের পরিমাণ কম হচ্ছে।
হাঁপানিয়া গ্রামের হাসান আলী জানান, রাস্তার দু’পাশ দিয়ে কিছু গাছ আছে। তাছাড়া জমির আইলের উপর এখন আর গাছ নেই। মাঠের সেই ৫০-৬০ বছর বয়েসের গাছ আর নেই। এ কারণে রসও অনেক কম।
গাছি মোজাফ্ফর হোসেন জানান, গাছ কাটার মানুষ নেই। এখন সবাই গাছে উঠতে ভয় পায়। ২-৩ বছর আগে গাছ কাটার অভাবে মাঠে অনেক খেজুর গাছ পড়ে থাকতো। তবে বর্তমানে মাঠে খেজুর গাছ নেই বলতেই হয়।
কৃষক রেজাউল করিম জানান, খেজুর গাছের বাগান নষ্ট হয়েছে ইট ভাটার কারণে। ৮-১০ বছর আগে মাঠের প্রতিটা আইলে এবং জমির মাঝেও খেজুর গাছ ছিলো। এখন আমাদের মোট মাঠে ১শ গাছ নেই।
যশোর জেলা কৃষি অধিদপ্তারের উপপরিচালক ড. সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, সাধারণত কৃষক খেজুর গাছের বাগান করতে চাই না। কারণ গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার মধ্যে অনেক জটিলতা রয়েছে। আমরা এ জটিলতাকে আধুনিকায়ন করতে প্রষ্টোয় আছি। এদিকে গাছের মালিকরাও গাছ থেকে রস আহরণ করে না। অন্য মানুষ দিয়ে করায়। এ জন্য উভয়ের লাভের পরিমাণও কম হয়। যার কারণে গাছির পরিমাণও কমে যাচ্ছে। আমাদের কৃষি বিভাগ থেকে প্রতিত জমিতে খেজুর গাছ লাগানোর জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। আবার সরকারি ভাবেও গাছিদের প্রণোদনা দেওয়া হচেচ্ছ। এ প্রণোদনা চালু থাকলেও কৃষক উদ্বুদ্ধ হবে। তবে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় রাস্তার দু’পার্শ দিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং বন বিভাগ খেজুরের চারা রোপন করে। এ চারা দেখা বা পরিচর্যার দায়িত্বও তাদের। গুড় উৎপাদন করে কৃষক যেহেতু কিছুটা লাভবান হচ্ছে। আশা করি গাছের পরিমাণও আর তেমন বেশি কমবে না।

































Discussion about this post