নিজস্ব প্রতিবেদকঃ নরসিংদীতে আতঙ্কের আরেক নাম তিন ভাইয়! চাঁদাবাজী থেকে সব ধরনের অপরাধ জগতের রাজা তারা। যেখানেই নির্মাণ কাজ সেখানেই তিন ভাইয়ের থাবা। দাবি করে মোটা অঙ্কের চাঁদা। দিতে ব্যর্থ হলেই হামলার স্বীকার হতে হয় ভুক্তভুগিদের।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, নরসিংদীতে চায়না ফারুক, সাদেকুর রহমান ওরফে বড়ি সাদেক ও খবির গড়ে তুলেছে অপরাধে সম্রজ্যে। ডজন ডজন মামলার আসামি তারা। একাধিকবার কারাভোগ করলেও আইনের ফাঁক দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে নতুন করে আবার অপরাধে খাতায় নাম লেখায়। মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাইলে রোষানলে পড়তে হয়। ফলে প্রাণভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না।
অবশেষে সম্প্রতি কয়েকজন ভুক্তভোগী এই তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এর মধ্যে গত ১৩ ডিসেম্বর আইজিপি ও ২০ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা পড়ে এই অভিযোগ।
অভিযুক্ত তিন ভাই চায়না ফারুক, সাদেকুর রহমান সাদেক ও খবিরের বাবা মৃত আলাউদ্দিন মেম্বার। তাদের বাড়ি নরসিংদী সদরের বাদুয়ারচর উত্তর পাড়া।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইজিপি’র কাছে যে অভিযোগ জমা পড়েছে তাতে বলা হয়েছে নরসিংদীতে গত ১০ বছরে যেসব আলোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, চাঁদাবাজি হয়েছে, মাদকের বিস্তার লাভ করেছে, এর মূলে রয়েছেন এই তিন ভাই। কালো টাকার থাবায় তারা সবসময় আইনের ঊর্ধ্বে থাকছেন। এমনকি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেলেও সাহসী সাক্ষীর অভাবে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় তারা বেরিয়ে আসেন এবং ফের একই কাজ শুরু করেন। তাদের সমর্থক ও সহযোগীরা গোটা নরসিংদী জনপদকে সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত করেছে।
৩ ভাইয়ের বিরুদ্ধে যত অভিযোগঃ
হাজীপুরের দেলোয়ার হত্যা, বাদুয়ার চরের চাঞ্চল্যকর এবাদুল্লা হত্যা, ছাত্রলীগ নেতা মাহিন হত্যা, সংগীতায় হোটেল মালিক রাজা মিয়া হত্যা ও হাজীপুর যুবলীগ নেতা সুজন হত্যার মতো আলোচিত হত্যা মামলাগুলোতে আসামি ছিলেন এই তিন ভাই।
এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিপ্লবকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, প্রবাসীর গাড়িতে ডাকাতির মামলাসহ বিদেশি পিস্তল ও গুলি নিয়ে একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছিলেন তিন ভাই। এর বাইরেও ফেনসিডিল ও ইয়াবা নিয়ে কক্সবাজার, টেকনাফ, ঢাকার বাড্ডা থানা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশের হাতে বহুবার গ্রেফতার হয়েছিলেন তারা। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে এলাকায় জমি দখল, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা ও চাঁদাবাজি তাদের আয়ের উৎস।
বড়ি সাদেকে’র বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:
হাজীপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন সাদেকুর রহমান ওরফে বড়ি সাদেক। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ৩ রাউন্ড গুলিসহ বিদেশি পিস্তল নিয়ে নরসিংদী গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় নরসিংদী মডেল থানা মামলা নম্বর ৬৫(০১)১৮। ওই মাসেই নরসিংদী রায়পুরাধীন হাসনাবাদ পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশদের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশ ফেরত প্রবাসীর গাড়িতে ডাকাতির সময় সিসি ক্যামেরায় রেকর্ড করা ভিডিও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। ওই ঘটনাতেও বড়ি সাদেক জড়িত ছিলেন। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলা নম্বর ৬৩(০১)১৮। এছাড়া ২০১০ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিপ্লবকে অপহরণ করে মুক্তিপণের জন্য মারধরের সময় র্যাব-১১ ভিক্টিমকে সাদেক বাহিনীর হাত থেকে উদ্ধার করে। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলা নম্বর ৫১(০৭)১০।
কে এই চায়না ফারুক:
২০১৬ সালে মে মাসে বাদুয়ার চর কাচারি বাজারের ব্যবসায়ী এবাদুল্লাহ ওরফে এবাদকে কুপিয়ে ও ভুড়ি কেটে বীভৎসভাবে হত্যা করে চায়না ফারুক ও তার বাহিনী। এ ঘটনায় দায়ের করা ৬৫(০৫)১৬ নম্বর মামলায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে আসামি হত্যার দায় স্বীকার করেন। ২০১৮ সালে পুলিশের ওপর ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর ঘটনাতেও আসামি ছিলেন তিনি। মামলা নম্বর ৭১(১২)১৮। নরসিংদীর জনবহুল বাজীর মোড় এলাকায় জনসভা চলাকালীন পুলিশ ও শতশত মানুষের সামনে হাজীপুর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান সুজিত বাবুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করেও আধিপত্য বিস্তার করেন চায়না ফারুক।
খবির মানে আতঙ্ক:
২০১১ সালের ডিসেম্বরে সংগীতার হোটেল মালিক রাজা মিয়াকে ফেনসিডিলের বোতলে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়, যার নেপথ্যে ছিলেন খবির। নরসিংদী মডেল থানায় মামলা নম্বর ৪২(১২)১১। কাছাকাছি সময়ে রাইফেলের গুলিসহ নরসিংদী ডিবি পুলিশের চেকপোস্টে গ্রেফতার হয়েছিলেন। রায়পুরা থানার মামলা নম্বর ২৩(০৩)১৩।
এছাড়া ৩৮৫ বোতল ফেনসিডিলসহ র্যাব-১০ রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রেফতার করেছিল খবিরকে। এ ঘটনায় বাড্ডা থানায় দায়ের করা মামলার নম্বর ১৬(০৫)১৬। এছাড়া ১০৫ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেফতারের ঘটনায় ৪১(০৮)১০ নম্বর এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে নরসিংদী মডেল থানায় দায়ের করা ৮(০২)১৮ নম্বর মামলারও আসামি তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, সম্প্রতি এই তিন ভাই ও তাদের বাহিনী যেখানে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়, সেখানেই মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করছেন। ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগীরা বলেন, এই তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে আরও অসংখ্য মামলা আদালতে বিচারাধীন। এর মধ্যে তাদের চাঁদাবাজির যন্ত্রণায় এলাকাবাসী অতীষ্ঠ। কিন্তু তাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। কারণ তাদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলেই তাকে করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়। আর বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হলেও টাকার জোরে তারা জামিন নিয়ে এসে ফের অপরাধ করতে শুরু করেন তারা।
ভুক্তভোগীরা আরও বলছেন, এই তিন ভাই এমনভাবে ত্রাস ছড়িয়ে চলেছেন যে কেউ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগই করেন না। ফলে পুলিশের খাতায় তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে, তা তাদের অপকর্মের মাত্র দুই শতাংশ হতে পারে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাদেকুর রহমান ওরফে বড়ি সাদেক বলেন, আমরা দোষী হলে আদালত আমাদের বিচার করবে। এ নিয়ে বলার কিছু নেই। আসলে একটি মহল আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
নরসিংদীর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিপ্লব কুমার বলেন, ফারুক, খবির ও সাদেকের নামে কিছু পুরনো মামলা রয়েছে। কিছু মামলা বিচারাধীন। কিছু মামলা চার্জশিটের অপেক্ষায় আছে। সব মামলাতেই তারা জামিনে আছেন। নতুন কোনো মামলা হয়নি। জামিনে থাকা আসামিকে তো আর আমরা ধরতে পারি না।
নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এনামুল হক সাগর বলেন, আইন আইনের গতিতে চলে। আমরা কোনো অপরাধীকে ছাড় দেই না। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে নিশ্চয় বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Discussion about this post