মনিরুজ্জামান মনির,যশোর জেলা প্রতিনিধি:
১নং খতিয়ানের একটি সরকারি রাস্তা ব্যক্তিগত কৃষি জমিতে পরিণত হওয়ার ফল ভোগ করছেন যশোর সদর উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের বীর নারায়নপুর গ্রামের বাসিন্দারা। কৃষি জমির সাথে মিশিয়ে নেয়া দেড় কিলোমিটার রাস্তা উদ্ধার করতে যেয়ে তারা আরো বেশি বিপাকে পড়েছেন। দফায় দফায় তদন্ত শেষে রাস্তাটি উদ্ধারে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারি কৌশুলীর মতামত জানতে চায় জেলা প্রশাসন। সরকারি কৌশুলী মামলা পরিচালনার জন্য ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা খরচ হবে মর্মে রিপোর্ট দিয়েছেন। এ রিপোর্টটিও পড়ে আছে বছরের বেশি সময়। রাস্তা উদ্ধারে কোন পথ না পেয়ে হতাশ বীর নারায়নপুরের বাসিন্দারা।
লেবুতলা ইউনিয়ন ভুমি সহকারী কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন ২০২৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সহকারী কমিশনার ভূমি বরাবর একটি প্রতিবেদন প্রেরণ করেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, বীরনারায়নপুর মৌজার এসএ ও সিএস ২৬ নং দাগের ২২৭ শতক ১নং খতিয়ানভুক্ত। জমিটি রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সে চিহ্ন এখনো প্রতীয়মান হয়। কিন্তু ১৬ জন ব্যক্তি তঞ্চকতা করে রাস্তাটি নিজেদেরে নামে হাল রেকর্ড করে নিয়েছে। ব্যক্তি মালিকনায় রেকর্ড হওয়া ১ নং খতিয়ানের জমি উদ্ধারে পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদন করেছেন তিনি।
এছাড়াও দীর্ঘ বছর ধরে বেদখলে থাকা এ সরকারি রাস্তা উদ্ধারের জন্য অতীতে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। সব কমিটিই তাদের প্রতিবেদনে রাস্তাটি ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ড হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে উদ্ধারে কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। তৎকালীন রেভিনিউ ডেপুটি কালেকটরেট তায়েব-উর-রহমান আশিক তদন্ত শেষে ২০১৯ সালে ২ ডিসেম্বর একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। যাতে জমিটি উদ্ধারে মামলা পরিচালনার পরামর্শ দেন তিনি। সে মোতাবেক মামলার বিষয়ে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য সরকারি কৌশুলীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। অতিরিক্ত সরকারি কৌশুলী প্রদীপ কুমার পাঠক এ রাস্তার উদ্ধার মামলা পরিচালনার জন্য আনুমানিক ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা খরচ হবে মর্মে রিপোর্ট দেন। এরপর থেকেই বিষয়টি এ অবস্থায় পড়ে আছে। এদিকে রাস্তাটি ব্যবহার করতে না পেরে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে এলাকার মানুষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, বীর নারায়নপুর গ্রামের ১৪৩নং মৌজার ২৬নং দাগের সরকারি রাস্তাটি বীর নারায়নপুর বাইপাস সড়কের জহুরুলের বাড়ি হতে মাঠের মধ্য দিয়ে শর্শুনাদহ গ্রামের পাশ দিয়ে ইব্রাহিম বিশ্বাসের সবজি ক্ষেতের পাশ দিয়ে মোল্যা পাড়ার ব্যক্তিগত ইটের রাস্তা হয়ে আবারও ঈদ গাহের পাশ দিয়ে বাইপাস সড়কের সাথে মিলিত হয়েছে। রাস্তাটির দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় কিলোমিটার। যা ইব্রাহিম বিশ্বাসের ক্ষেত হতে শরিফুল ইসলামের ক্ষেত পর্যন্ত ৯৫০ ফুট ব্যবহৃত হচ্ছে। শরিফুল ইসলামের ক্ষেত হতে নন্দ ঘোষের জমির কার্পেটিংয়ের সড়ক পর্যন্ত ২৯ হাজার ৯২০ ফুট রাস্তা দৃশ্যমান হলেও মাঠি কেটে কৃষি জমির সাথে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে।
শর্শুনাদহ গ্রামের আব্দুল কাদের জানান, এ রাস্তাটি চালু হলে সহজে সবজি উঠিয়ে বাজারে নেওয়া যেত। এখন কোন ভ্যান পাওয়া যায় না। সবজি রাস্তায় নিতে শ্রমিক ঠিক করতে হয়। আবার শীতের সময় ভোরে শ্রমিক পাওয়া খুব কঠিন। এ রাস্তাটি হলে কোন চিন্তা থাকতো না আমাদের।
শর্শুনাদহ গ্রামের সবুর আলী জানান, চলাচলের সরকারি রাস্তা তো বন্দোবস্তর বা বিক্রি করার কোন সুযোগ নেই। এখানে বোঝা যাচ্ছে জালিয়াতি করেছে। সেখানে সরকার ইচ্ছা করলে মনে হয় যখন তখন এ রাস্তা চলাচলের জন্য চালু করতে পারে।
কৃষক ইব্রাহিম হোসেন জানান, এ রাস্তাটি এক দেড়’শ বছরের আগের রাস্তা। সিএস রেকর্ড বলে ২৭ সালের রাস্তা। কিন্তু আমরা শুনেছি আরো অনেক আগে থেকে রাস্তাটি ছিল। কয়েকজন মিলে এ রাস্তা দখল করে। তখন ওদের উপর কেউ কিছু বলার সাহস ছিলো না।
কৃষক আশরাফুল ইসলাম জানান, আমার জমির পাশ দিয়েও রাস্তা ছিল। কিন্তু কয়েকজন এ রাস্তা কিনছে বলে মাঠি কেটে তদের জমির সাথে এক করে নিয়েছে। আসলে আমাদের খুবই বিপদ। মাঠে সবজি ফলতে দেখলে ভালই লাগে। কিন্তু সবজি মাঠ থেকে তুলে রাস্তা পর্যন্ত নিতে গেছে মাথা নষ্ট হয়ে যায়। আবার দু’গ্রামের সংযোগও নষ্ট। পাশাপাশি গ্রাম হলেও যোগাযোগ করতে ৫ কিলোমটিার ঘুরে আসতে হয়।
বীর নারায়নপুর গ্রামের ইসমাইল হোসেন জানান, ‘এ রাস্তা যারা দখল করছে তারা হুমকি ধামকি দেই আমাকে। কারণ তারা বলে রাস্তা উদ্ধারের বুদ্ধি নাকি আমার। আমি জমি সম্পর্কে একটু বুঝি তাই। কয়েক বছর আগে আমাদের এলাকার লোকজন রাস্তা ফিরে পাওয়ার দাবিতে মানববন্ধন করে। তখন আমি প্রায় ৩’শ জনের গণস্বাক্ষর নিয়ে ডিসি স্যারের নিকট সরাসরি আবেদন দেই। আর এ কারণে আমাকে বিভিন্ন সময় চাপ তৈরি করে। এ রাস্তাটি চালু হলে দু’গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা বৃদ্ধি পাবে।’
লেবুতলা ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা কামাল হোসেন বলেন, আমরা সরেজমিনে তদন্ত করে চলাচলের রাস্তা প্রমানিত হওয়ায় কয়েকবার কাগজপত্র দিয়েছি। আবারও কিছু কাগজপত্র দেওয়ার জন্য বলেছে। আমি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করে পাঠিয়ে দিয়েছি।
যশোর সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহমুদুল হাসান বলেন, ১৪৩নং মৌজার রাস্তার জমি ফিরিয়ে আনার জন্য মূল কপিসহ মামলার জন্য কোর্টে পাঠানো হয়। কিন্তু কোর্ট মামলার জন্য আরো কিছু কাগজ পত্রের জন্য চিঠি করে পাঠিয়েছে। আমি এ কাগজপত্র দেওয়ার জন্য লেবুতলা ভূমি কর্মকর্তাকে নির্দেশ করছি। বাকি কাগজপত্র আসলে রাস্তাটি ফিরিয়ে আনার জন্য আবারও মামলা করার জন্য পাঠানো হবে।
যশোর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) তুষার কুমার পাল বলেন, আমরা এ রাস্তা ফিরিয়ে আনার জন্য দেওয়ানি মামলার নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু এখনো ফিরিয়ে আনার জন্য কেন মামলা হচ্ছে না, বারবার কেন তদন্তে পাঠিয়ে সময় নেওয়া হচ্ছে এ বিষয়টি আমি খোঁজ খবর নিয়ে দেখবো।
Discussion about this post